আইন-আদালত: জমিজমার মালিকানা ও দখল স্বত্ব

প্রকাশিত: ৭:৩৭ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১৮, ২০২১

আইন-আদালত: জমিজমার মালিকানা ও দখল স্বত্ব

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

যিনি দখলে আছেন জমি তার না জমির কাগজপত্র যার আছে জমি তার, না অন্য কারও। বিখ্যাত শিল্পী আবদুল আলীমের কণ্ঠে একটি গান আছে- ‘পরের জায়গা পরের জমিন/ঘর বানাইয়া আমি রই/আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।’ ঘরের মালিক যে প্রকৃত অর্থে কে তা নিয়ে এ পৃথিবীতে কম বিপত্তি ঘটেনি। বলা যায়, মানুষে মানুষে সবচেয়ে বেশি দ্বন্দ্ব-বিবাদ হয়েছে জমি বা সম্পত্তির অধিকার নিয়ে। দখলিস্বত্ব বলে একটা কথা আছে। একজনের নামে থাকা জমি ১২ বছর ধরে অন্যজনের ভোগদখলে থাকলেই সে জমি তার হয়ে যাবে- এমন পুরনো আইন কিন্তু এখনো বহাল রয়েছে। দখলদার যাতে জমির মালিক না হয়ে যায় সেজন্য ‘ভূমির ব্যবহারস্বত্ব গ্রহণ আইন-২০২০’ নামে নতুন একটি আইন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা সবাই জানি, একজনের জমি আরেকজন জোরজবরদস্তি করে দখল করে রাখবে তা সম্পূর্ণ অন্যায় ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আইন বলছে, জোর করে ১২ বছরের অধিককাল দখলদার ব্যক্তি বড়জোর প্রতিকূল দখলের দাবিতে মামলা করতে পারেন। কিন্তু জমির স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না। আবার উচ্চ আদালত বলছে, বাদী স্বত্ব দখল প্রমাণ করতে পারলেই স্বত্ব প্রচারের ডিক্রি পাবেন। ৬০ ডিএলআর ২৯ পৃষ্ঠায় এ রকম একটি সিদ্ধান্তও রয়েছে। শুধু জমির কাগজপত্র, দলিল-দস্তাবেজ থাকলেই হবে না এক্সক্লুসিভ পজিশনও থাকতে হবে। উচ্চ আদালত বলছে, এক্সক্লুসিভ পজিশন ইজ দ্য বেটার কেস। আপনার জমি কিংবা বাড়ি আছে অথচ আপনি জমির ব্যবহার কিংবা সে বাড়িতে বসবাস করছেন না। এগুলো দেখাশোনার জন্য নিজের আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী কিংবা বিশ্বস্ত কাউকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এ সুযোগে আপনার মালিকানাধীন জমি কিংবা বাড়ি রক্ষক নিজের বলে দাবি করছেন কিংবা গায়ের জোরে দখল করে নিতে চাইছেন। এমনকি কিছু অংশ তো দখলই করে নিয়েছেন। এখন আপনি কী করবেন, কীভাবে দখলচ্যুত করা জমি কিংবা বাড়ি ফিরিয়ে নেবেন, এর জন্য কত সময় ও টাকা খরচ হবে?

দেশে জমির ভোগদখলসংক্রান্ত যে আইনটি রয়েছে তা ব্রিটিশ আমলের, ১৮৮৫ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশে অনেক আইনের পরিবর্তন হলেও এ আইন আগের মতোই রয়ে গেছে। এতে কারও জমি অন্যজন ১২ বছর ভোগদখল করলে সে জমির মালিকানা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে। ধরুন করিম সাহেব ঢাকায় চাকরি করেন। তার কুষ্টিয়ায় একটি বাড়ি আছে। সে বাড়িতে তার পরিচিত সুজনকে থাকার জন্য সুযোগ দিলেন। প্রায় ১৩ বছর ধরে সুজন ওই বাড়িতে বসবাস করছেন। এলাকার লোকজনও জানে এটা সুজনের বাড়ি। এখন করিম সাহেব চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। গ্রামে এসে তার বাড়িতে থাকতে চান। তিনি আইনত সুজনকে গায়ের জোরে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারবেন না। স্বেচ্ছায় না যেতে চাইলে করিম সাহেবকে দেওয়ানি আদালতে মামলা করে সুজনকে বেদখল করতে হবে। যদি জোর করে বের করে দেন তবে সুজন দেওয়ানি আদালতে মামলা করে তার দখল বজায় রাখতে পারবেন। এখানে দখলকারীর স্বত্ব বিবাদীর স্বত্বের চেয়ে ভালো বা বিবাদীর কোনো স্বত্ব আছে কি না তা দেখার কোনো দরকার হয় না। এখানে আদালত স্বত্বের বিষয় বিবেচনা করে না। শুধু দখলের বিষয় বিবেচনা করে। আমাদের ভূমিসংক্রান্ত ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের ২৮ ধারা অনুযায়ী যদি কেউ বিনা বাধায় কারও জমি একাধারে ১২ বছর দখলে বা ভোগদখল করে রাখতে পারেন তবে তিনি ভূমির মালিকানা দাবি করে আদালতে মামলা করতে পারেন। দখলদার যদি আদালতে বিষয়টি প্রমাণ করতে পারেন তবে তিনি ওই জমির মালিকানা পেতে পারেন। সে কারণে দখলদার ও ভূমির মালিকের বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি নতুন আইন হওয়া দরকার। যদিও উচ্চ আদালত বলছে, অবৈধ দখলকার জমিতে মূল মালিকের বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা পাওয়ার অধিকারী নয়। (৬০ ডিএলআর, ৯)। কিন্তু জমির কাগজ আছে জমি দখলে নেই তাহলে সিম্পল ডিক্লারেশন অব টাইটলের মামলা বারিত হবে বলে উচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছে, যা ৪২ ডিএলআরের ৪৩৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে। কারণ দখলদারের স্বত্ব যে অস্বীকার করে তাকেই স্বত্ব প্রমাণ করতে হয়। আরেকটু বলে রাখি, জমি থেকে অবৈধভাবে দখলচ্যুত হলে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ও ৯ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার চেয়ে দেওয়ানি আদালতের আশ্রয় নিতে হয়। এ আইনের ৮ ধারা অনুযায়ী দখলচ্যুত ব্যক্তিকে ওই জমিতে তার স্বত্ব বা মালিকানা আছে বলে প্রমাণ দিতে হয়; নইলে এ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার পাওয়া সম্ভব হয় না। ৯ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার পেতে গেলে বাদী শুধু দখলচ্যুত হয়েছেন এ মর্মে প্রতিকার চাইতে পারেন, স্বত্ব বা মালিকানা প্রমাণের দরকার নেই। কারণ জমিতে স্বত্ব যার, আদালত দখল তার অনুমান করবে। অবৈধ দখলদারের ক্ষেত্রে অনুরূপ অনুমানের অবকাশ নেই। (৩৬ ডিএলআর, ২৬৮)। ৯ ধারার ক্ষেত্রে যেসব দিক বিবেচনা করা হয় সেগুলো হলো- বাদী জমিটি দখল করে আসছিলেন কি না, বিবাদী তা জোরপূর্বক বেদখল করেছেন কি না, বিবাদী বেআইনিভাবে জমিতে প্রবেশ করেছেন কি না। তবে সরকারের বিরুদ্ধে ৯ ধারায় মোকদ্দমা করা যায় না। ৮ ধারার স্বত্ব প্রমাণসহ মামলা করার ক্ষেত্রে বেদখল হওয়ার পর থেকে ১২ বছরের মধ্যে মোকদ্দমা করতে হবে। এসব প্রতিকারের ক্ষেত্রে জমির মূল্যমানের ওপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট এখতিয়ারাধীন আদালতে মামলা করতে হবে এবং মূল্য অনুপাতে কোর্ট ফি জমা দিতে হবে। ৯ ধারায় মোকদ্দমার ক্ষেত্রে মূল্য অনুপাতে কোর্ট ফির (এডভেলোরেম) অর্ধেক জমা দিতে হয়। উচ্চ আদালত বলছেন, বেআইনিভাবে সদ্য দখলচ্যুত ব্যক্তি উক্ত দখল পুনরুদ্ধারের জন্য ৯ ধারায় মোকদ্দমায় ডিক্রিপ্রাপ্ত হয়ে ডিক্রি জারিতে নালিশি জমিতে দখল নিতে পারেন। প্রতিপক্ষ তার বিরুদ্ধে কোনোক্রমেই ডিক্রি জারিতে বাধা দেওয়ার জন্য নিষেধাজ্ঞার দাবি করতে পারে না। (৪০ ডিএলআর (এডি), ২৫১)।

লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

সুত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন

সংবাদ অনুসন্ধান ক্যালেন্ডার

MonTueWedThuFriSatSun
  12345
2728     
       
28      
       
       
       
1234567
2930     
       

আমাদের ফেইসবুক পেইজ