সিলেট ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ২১শে মাঘ, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:৩৯ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ৪, ২০২২
শাইখ সিরাজ :: জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস ছিল গতকাল ৩ ডিসেম্বর। ১৯৯২ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, পৃথিবীতে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬৫ কোটি। এর মধ্যে ২০ কোটিই শিশু। আর বাংলাদেশের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশের মানুষের শতকরা প্রায় ৭ ভাগ প্রতিবন্ধী। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে সচেতনতা প্রসার এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মর্যাদা সমুন্নতকরণ, অধিকার সুরক্ষা এবং উন্নতি সাধিত হোক এ প্রত্যাশা রেখে আজ এই দিবসে ফিলিপিন্সের একটি ব্যতিক্রমী কৃষি খামারের গল্প বলতে চাচ্ছি।
গত আগস্টে ফিলিপিন্সের কৃষি উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে সে দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ফিলিপিন্সের লাগুনা প্রভিন্সের লিলিউতে অবস্থিত একটি অর্গানিক খামার দেখতে গিয়ে মুগ্ধ হয়েছি। খামারটির নাম ‘সাইলেন্ট ইন্টিগ্রেটেড ফার্ম’। খামারে ঢুকেই মনটা জুড়িয়ে গেল, রঙিন ছাতায় মোড়ানো পথ আর সুশৃঙ্খল সবুজ নিসর্গ দেখে। সুনসান নীরবতা, যেন নামকরণে মিলে এখানে সব কিছুই সাইলেন্ট। চারপাশ সাজানো-গোছানো ফসলি সমাবেশ। যা নিয়ে কাজ করছেন একদল বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ। যারা শারীরিক ও মানসিক সীমাবদ্ধ নিয়েও কৃষিকাজ করছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নে, খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে নীরবে ভূমিকা রাখছেন। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের পাশাপাশি এখানে কাজের সুযোগ পেয়েছেন স্থানীয় সিনিয়র সিটিজেন। সব মিলে সম্পূর্ণ অর্গানিক ও স্বাস্থ্যসম্মত কৃষিক্ষেত্রটি পরিণত হয়েছে ভিন্ন এক দৃষ্টান্তে। খামারে কর্মরত এক তরুণ কৃষিবিদ উইল জন। তিনিই অভ্যর্থনা জানিয়ে আমাদের খামারের ভিতরে নিয়ে গেলেন। সাড়ে তিন হেক্টর অর্থাৎ প্রায় ২৫-২৬ বিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠা সাইলেন্ট ইন্টিগ্রেটেড ফার্মটির মূল উদ্যোক্তা ২৩ বছর বয়সী একজন তরুণী। যিনি নিজেকে সবসময়ই আড়ালে রাখেন। জনের কাছে জানতে চাইলাম আচ্ছা জন, এখানে যা উৎপাদন হচ্ছে সবই কি জৈব কৃষির অনুশীলনে? জন বললেন, সবই অর্গানিক। এখানে ব্যবহৃত সার, বালাইনাশকও অর্গানিক প্রক্রিয়ায় তৈরি। খামারটি ঘুরে দেখলাম সেখানে পেঁপে, লেটুস, শসা, শিম, বেগুন, টমেটোসহ নানারকম সবজি ও ফলমূল উৎপাদন হচ্ছে। জনের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, খামারে কর্মরত বেশির ভাগ মানুষই বধির। কয়েকজন সিনিয়র সিটিজেনও রয়েছেন। যাদের কর্মক্ষমতা কমে গেছে, তবুও কাজের সুযোগ পেয়েছেন তারা।
সেখানে উপস্থিত ছিল মাইকেল ও দানিকা দম্পতি। তারা দুজনই একেবারেই কানে শোনেন না। কথাও বলতে পারেন না। ইশারায় কথা বলেন। দুজন পরস্পরকে ভালোবেসে ঘরও বেঁধেছেন। ফুটফুটে দুই শিশু সন্তান নিয়ে কাজের সন্ধানে ঘুরেছিলেন পথে পথে। অবশেষে কাজের সন্ধান মিলেছে সাইলেন্ট ফার্মে। তারা ভিতরে লুকিয়ে থাকা অমিত শক্তি দিয়ে জয় করছেন এই ফসলি সংসার। প্রমাণ করছেন, মানুষের মাঝে যদি সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছাটুকু থাকে, তাহলেই তিনি সক্ষম। জনের সহায়তায় এই দম্পতির সঙ্গে কথা হলো আমার। আমার কথা জন ইশারা ভাষায় তাদের বুঝিয়ে দিলেন, তাদের ইশারা ভাষা কথায় বুঝিয়ে দিলেন আমাকে। মাইকেল এখানে গত ১০ মাস ধরে কাজ করছেন। জমি চাষ থেকে ফসলের যত্ন নেওয়া, আগাছা বেছে ফেলা, নিড়ানি দেওয়া, ফসল উত্তোলন সব ধরনের কাজই করেন। এমনকি খামারের দেখাশোনার কাজটিও তিনি করেন। খামারে সবাই আট ঘণ্টার শিফটে কাজ করেন। কয়েকজন ছিলেন বিশ্রামে। আবার কয়েকজন কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ম্যানিলাতে অবস্থান করছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম খামারটির পোলট্রি অংশে। সেখানে মুরগির শেডগুলো তৈরি করা হয়েছে স্থানীয় ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে। মুরগিগুলোও স্থানীয় জাতের। সেখান থেকে গেলাম খরগোশের খামারে। সাদা ও কালো রঙের অনেকগুলো খরগোশের দেখা মিলল। সব বাণিজ্যিক উদ্দেশে লালন-পালন করা হচ্ছে। শুধু খামার স্থাপনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি উদ্যোক্তা। অর্গানিক ফসল উৎপাদন এবং প্রাণিসম্পদের খামার ব্যবস্থাপনার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রেখেছেন। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কথা হলো প্রশিক্ষক মাইকেল কাগাসের সঙ্গে। তিনি মূলত ভার্মি কম্পোস্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। জানতে চাইলাম, আপনাদের দেশে জৈব কৃষি অনুশীলন কেমন চলছে এখন? মাইকেল কাগাস বললেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মুক্ত নই আমরা কেউই। দিনে দিনে আমরাও ফসল উৎপাদনে চরম ঝুঁকির মুখে পড়ছি। এ জন্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান আর জৈব কৃষিচর্চার এখন বিকল্প নেই। বিশেষ করে কম খরচে অধিক উৎপাদন করে সুস্থ থাকার অন্যতম পথ হলো বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনের পথ বেছে নেওয়া। খামারে শুধু শারীরিক প্রতিবন্ধীরা কাজ করছেন না। কাজ করছেন সাধারণ শিক্ষার্থী এবং সাধারণ কৃষিশ্রমিকও। কথা হলো একজন তরুণ শিক্ষার্থীর সঙ্গে। নাম জন জেসপার। পড়াশোনার পাশাপাশি বেছে নিয়েছেন বধির মানুষের সঙ্গে কাজের সুযোগ। দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘণ্টা কাজ করে আয়ও হচ্ছে। কাজ করছিলেন তরুণী লামিসাও। ফসল তুলে ফিরছিলেন তিনি। হাতের ঝুড়িতে সতেজ শসা, টমেটোসহ নানারকম সবজি। লামিসা বলছিলেন, সবই বিষ ও রাসায়নিকমুক্ত ফসল। তারা নানারকম জৈব বালাইনাশক ও সেক্সফেরোমন ট্র্যাপ ব্যবহার করেন। সুতরাং কোনো দরকার হয় না কীটনাশক ব্যবহারের। লামিসা ফসলগুলো নিয়ে যাচ্ছিলেন ফার্ম সংলগ্ন প্রদর্শনী স্টলে। তার সঙ্গে সঙ্গে প্রদর্শন কেন্দ্র বা স্টলে গেলাম। বিভিন্ন তাকে তাকে সাজানো সতেজ ও তরতাজা ফল-ফসল। প্রদর্শনীর পাশে যুক্ত আছে ফার্ম টু টেবিল কনসেপ্টে একটি খাবারের জায়গা। সেখানে যে কেউ চাইলেই বিষমুক্ত ও তরতাজা ফসলে রান্নার স্বাদ গ্রহণ করতে পারে অর্থের বিনিময়ে। অতিথি কিংবা পর্যটকদের মতো আমরাও সেখানে মধ্যাহ্নভোজে যুক্ত হয়েছিলাম। অনেক চেষ্টা করেও এই খামারের মূল উদ্যোক্তা সেই তরুণী সম্পর্কে জানতে পারলাম না, সাক্ষাৎ পাওয়া তো বহুদূরের কথা। সবার আড়ালে থেকে নীরবে নীরব মানুষদের কল্যাণে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘সাইলেন্ট ইন্টিগ্রেডেটে ফার্ম’। ফিলিপিন্সের লাগুনা প্রদেশের লিলিউর মাটিতে দাঁড়িয়ে স্মরণ হলো, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। এই পৃথিবীতে আমরা যা কিছু দেখছি, যা কিছু করছি সবই মানুষের জন্য। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ কথাটি ভুলে যাই আমরা। অথচ আমাদের একটু চেষ্টা বা ইচ্ছাতেই মানুষের সামান্য সীমাবদ্ধতা কিংবা ত্রুটি উপেক্ষা করে একটি স্বপ্নকে জাগিয়ে দেওয়া সম্ভব। জাগিয়ে দেওয়া সম্ভব মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মেধা বা শক্তিকে। যা কাজে লাগিয়ে একজন এক বা বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতায় আটকে থাকা মানুষ আনতে পারে সাফল্য। বেঁচে থাকতে পারে জীবিকার লড়াইয়ে। যেমন সুযোগ দিয়ে দৃষ্টান্ত গড়েছেন সবার আড়ালে থাকা ফিলিপিনো এক তরুণী। তার সমন্বিত এক কৃষি উদ্যোগের মাধ্যমে মানব সেবার যে উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে তা ছড়িয়ে যাক পৃথিবীর সবখানে, সব মানুষের মাঝে।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
সূত্র : বিডি প্রতিদিন
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ নাজমুল কবীর পাভেল
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : জুমা কবীর মিম
সহ সম্পাদকঃ আরিফ মাহবুব
নির্বাহী সম্পাদকঃ ধ্রুব জ্যোতি দে
ব্যবস্থাপনা সম্পাদকঃ মাহমুদা আক্তার বিউটি
আইটি সম্পাদক : মাসুম আহমদ
উপদেষ্টা সম্পাদক : এ্যাডভোকেট জাহানারা বেগম
ইমেইল: sylnewsbd@gmail.com, pavel.syl@gmail.com
ফেইসবুক পেইজ : Syl News BD
মোবাইলঃ 01712-540420
শ্রীহট্ট মিডিয়া লিমিটেডের একটি প্রতিষ্ঠান।
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি