অবৈধ অস্ত্র বাণিজ্যে শতাধিক সিন্ডিকেট

প্রকাশিত: ১১:০০ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২১

অবৈধ অস্ত্র বাণিজ্যে শতাধিক সিন্ডিকেট

ডেস্ক

সীমান্ত দিয়ে আসছে অস্ত্র। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অস্ত্র আমদানি করে তা বিক্রি করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। অবৈধ অস্ত্র বাণিজ্যে জড়িত শতাধিক সিন্ডিকেট। গণমাধ্যমে লেখালেখি হলে সীমান্তে কড়াকড়ি হয়, কিছুদিন পর আবারো ফিরে আগের অবস্থায়। এক শ্রেণির অসাধু সরকারি দায়িত্বশীলদের সহযোগিতায় অস্ত্র কারবারিরা মারণাস্ত্র আমদানি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে তা সন্ত্রাসী, ডাকাত, ছিনতাইকারী ও কিশোর গ্যাংয়ের হাতে চলে যাচ্ছে। ঘটছে খুন-খারাবির মতো ঘটনা। এমনকি বিদেশি অস্ত্রের আদলে অত্যাধুনিক বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়।

সম্প্রতি রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেড়েছে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। প্রকাশ্যে এসব অস্ত্র প্রদর্শন হলেও রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মাদকের মতোই নানা কৌশলে অস্ত্র আনা হচ্ছে। মাদক ও অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে সাধারণত একই সিন্ডিকেট জড়িত। যশোরের বেনাপোল, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, সাতক্ষীরার শাঁকারা, মেহেরপুর, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, কুমিল্লা, কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, সিলেটের তামাবিলসহ অন্তত ৩০টি রুট দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে দেশে অবৈধ অস্ত্র আনা হচ্ছে। অবৈধ অস্ত্রের শতাধিক কারবারির তালিকা রয়েছে গোয়েন্দাদের হাতে। এরমধ্যে বেশির ভাগই বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হয়েছে। কারাগারে রয়েছে অনেকে। আবার পার্শ্ববর্তী দেশে আত্মগোপনে থাকা অনেক সন্ত্রাসীর নামেও চলছে এই বাণিজ্য। গোয়েন্দাদের মতে, প্রতিদিন অবৈধ অস্ত্র আমদানি হলেও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)’র হাতে জব্দ হচ্ছে খুবই কম। গত আগস্টে বিজিবি জব্দ করেছে ছয়টি পিস্তল, ১২টি বিভিন্ন প্রকার অস্ত্র, দুটি ৪০ মি. মি. মর্টার বোম্ব, তিনটি ৬০ মি. মি. মর্টার বোম্ব, একটি ম্যাগাজিন এবং ২৮ রাউন্ড গুলি। সীমান্ত এলাকার কাঁটাতারের ওপর দিয়ে বস্তায় ভরে ওপার থেকে এপারে বিশেষ কৌশলে পাঠানো হয় অস্ত্র। অনেকটা বস্তাবন্দি ফেনসিডিলের মতো ঢিল ছুড়ে দিলেই সীমানা পার হয়ে যায়। অনেক সময় পণ্যবাহী গাড়িতে করে গোপনে অস্ত্র আনা হচ্ছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে অস্ত্র আমদানি করছে চক্রগুলো। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক চালান অস্ত্র ঢুকেছে ঢাকায়। তা ছড়িয়ে গেছে বিভিন্ন এলাকায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকায় মাঝে-মধ্যে অস্ত্র জব্দসহ জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

গত ৫ই সেপ্টেম্বর নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের দুটি গ্রুপ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ সময় সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করা হয়। শটগান ও পিস্তল দিয়ে প্রতিপক্ষকে টার্গেট করে গুলিবর্ষণ করা হয়। এরআগেও ওই এলাকায় একইভাবে সংঘর্ষের ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করে রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসীরা। ঘটেছে হত্যাকাণ্ডও। গত ৩০শে আগস্ট চট্টগ্রামের চন্দনাইশের হাশিমপুরে জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে সংঘর্ষের পর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ করে এক পক্ষ। এ সময় একজনকে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করতে দেখা যায়। গুলিবর্ষণের ওই দৃশ্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তাদের গ্রেপ্তারে মাঠে নামে র?্যাব। পরবর্তীতে সাবেক যুবলীগ নেতা গিয়াস উদ্দিনসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এভাবে প্রায়ই দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যবহার করা হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। এমনকি কম বয়সী ছেলেদের কাছে রয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। সম্প্রতি সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করছে।

র‌্যাব-৪-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন, কিশোর গ্যাংয়ের হাতে যেসব অস্ত্র আসছে, সেগুলো পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্ত দিয়ে আনা হয়েছে। অবৈধ এসব অস্ত্র আমদানি করছে একটি সিন্ডিকেট। পরবর্তী সময়ে এসব অস্ত্র দিয়ে মানুষকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। এসব অস্ত্র দিয়ে বড় অপরাধও করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

সূত্রমতে, পাড়া-মহল্লা নিয়ন্ত্রণকারী নেতাদের সহায়তায় অস্ত্র পাচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। কয়েক মাস আগে ঢাকার আশুলিয়ার নাল্লাপাড়া এলাকায় মসজিদের খাদেম নজরুল ইসলামকে কুপিয়ে জখম করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এ ঘটনায় কিশোর রাকিব হোসেন ও তার সহযোগী ইমন হোসেনকে গ্রেপ্তার করার পর এই মন্তব্য করেন র‌্যাব কর্মকর্তা। তাদের কাছ থেকে দুটি পিস্তল, চার রাউন্ড গুলি, একটি ম্যাগাজিন, একটি চাইনিজ কুড়াল, দুইটি ফোল্ডিং চাকু, চাপাতি ও ৩শ’ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়।

গত ১লা সেপ্টেম্বর ৮টি বিদেশি পিস্তল, আট রাউন্ড গুলি, ১৬টি ম্যাগাজিন ও একটি প্রাইভেটকার জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় পাঁচজনকে। অস্ত্র কারবারিদের এই চক্র সীমান্তবর্তী এলাকা যশোরের বেনাপোল থেকে অস্ত্র ও গুলি সংগ্রহ করে তা সারা দেশে ওই গাড়ির মাধ্যমে অপরাধীদের কাছে সরবরাহ করে। ডিএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, অবৈধভাবে ভারত থেকে আগ্নেয়াস্ত্র আমদানিকারীদের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তদন্তের একপর্যায়ে গোয়েন্দা তথ্য ও তথ্য প্রযুক্তি বিশ্লেষণ করে দারুস সালাম থানার বেড়িবাঁধ বড় বাজার এলাকা থেকে অস্ত্রসহ জড়িতদের গ্রেপ্তার করে ডিবি। ২০১৪ সাল থেকে অস্ত্র বেচাকেনা করছে এই চক্র। এ বিষয়ে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।

অস্ত্র আমদানি ছাড়াও বিদেশি অস্ত্রের অনুকরণে অস্ত্র তৈরি হচ্ছে দেশে। খুলনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় লেদ মেশিনে অস্ত্র তৈরির খবর রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। অভিযানও হয়েছে। জড়িতদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হলেও নানা কৌশলে অস্ত্র আমদানি ও তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের আকবর শাহ এলাকায় অভিযান চালিয়ে দেশে তৈরি অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ ফারুক নামে এক যুবককে আটক করে। অস্ত্রটি ইংল্যান্ডের ওয়েবলি অ্যান্ড স্কট কোম্পানির রিভলবারের মতোই। দেখতে বিদেশি পিস্তল মনে হলেও গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছেন, তা তৈরি হচ্ছে দেশেই। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার বংশাল পাড়ায়, মহেষখালীর পাহাড়ি এলাকা ও রাজশাহী, খুলনা, মুন্সীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অস্ত্র জব্দ ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। তারপরও থামছে না অস্ত্রের ঝনঝনানি। এ বিষয়ে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সতর্ক হতে হবে বলে মনে করছেন বিশেজ্ঞরা।

সংবাদ অনুসন্ধান ক্যালেন্ডার

MonTueWedThuFriSatSun
  12345
2728     
       
28      
       
       
       
1234567
2930     
       

আমাদের ফেইসবুক পেইজ