পরকীয়া : ভুক্তভোগীর আইনি প্রতিকারে এত বাধা কেন?

প্রকাশিত: ১২:৩৩ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৯, ২০২২

পরকীয়া : ভুক্তভোগীর আইনি প্রতিকারে এত বাধা কেন?

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক :: পরকীয়া হচ্ছে বিবাহিত জীবন থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো নারী বা পুরুষের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া। বেশির ভাগ পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে ওঠে নারী বা পুরুষের শারীরিক ও মানসিক চাহিদা মেটানোর জন্য। মোবাইল ফোন, ফেসবুকসহ নানা প্রযুক্তি মানুষের হাতের মুঠোয় হওয়ায় পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে তোলাও অনেক সহজ।

পরকীয়ার সাজাসংক্রান্ত দন্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় বলা হয়েছে- কোনো ব্যক্তি কোনো মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করলে এবং ওই মহিলার স্বামীর অনুমতি না থাকলে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে। কোনো স্ত্রী পরকীয়া করলে যার সঙ্গে পরকীয়া করবেন শুধু সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রয়েছে। অথচ স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীর কিছুই করার নেই। একইভাবে স্বামী পরকীয়া করলে স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে বা যার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িত হবে তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকার পাবেন না। উপরন্তু স্বামী যদি কোনো বিধবা বা অবিবাহিত নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন এবং স্ত্রী যদি স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে পরকীয়ায় জড়িত হন তা আইনত বৈধ। সে কারণে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের উচ্চ আদালত এ ধারাটি কেন অবৈধ এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, এ আইন স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। মহিলাদের স্বাতন্ত্র্য খর্ব করে। স্বামী কখনই স্ত্রীর প্রভু বা মালিক হতে পারে না। তবে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হতে পারে বলে মত দিয়েছে। একটি কেস স্টাডি আপনাদের মধ্যে উপস্থাপন করলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে। সুজন ও রিতার দাম্পত্য জীবন ভালোই চলছিল। হঠাৎ একটি মোবাইল ফোন তাদের সুখের সংসার তছনছ করে দেয়। সুজনের এক বন্ধু তাকে ফোন করে জানান তার স্ত্রী অন্য এক ছেলের সঙ্গে একটি শপিং মলে ঘোরাফেরা করছেন। ব্যবসায়ী সুজন তখনই ওই শপিং মলে গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে থাকা ছেলেটির পরিচয় জানতে চান। সুজনের স্ত্রী উল্টো তাকে প্রশ্ন করেন ‘আপনি কে? আপনাকে তো আমি চিনি না।’ সুজন রাগ সংবরণ করতে না পেরে স্ত্রীকে কয়েকটি থাপ্পড় মারেন। নারীর গায়ে হাত তোলার অপরাধে উপস্থিত নিরাপত্তা-রক্ষীরা সুজনকে পাকড়াও করে পুলিশে দেন। পুলিশের জেরায় সব সত্য প্রকাশ করেন রিতা।

এ সময় রিতার প্রেমিক পুলিশকে বলেন, ‘রিতার সঙ্গে আমার এক বছরের সম্পর্ক। অবিবাহিত হিসেবে পরিচয় দিয়েছে আমার কাছে। সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।’ স্বামীকে না চেনার ভান করায় সুজনও রিতাকে ঘরে নিতে অস্বীকার করেন। ঘটনার কিন্তু এখানেই শেষ নয়। শেষমেশ রিতা সুজনের কাছে ক্ষমা চান এবং ওই প্রেমিকপুরুষটি তাকে ভুল বুঝিয়ে এ পথে নামিয়েছেন জানিয়ে তার বিচার দাবি করেন। সুজন শেষমেশ রিতার কথামতো ওই প্রেমিকপুরুষের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকে দেন।

তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ব্যভিচারের ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের কোনো শাস্তির বিধান আইনে নেই। ওই স্ত্রীলোকটি যে দুষ্কর্মের সহায়তাকারিণী বা ব্যভিচারের অপরাধে দোষী অথচ তিনি কোনো সাজা পাবেন না। এ বিষয়ে লাহোর হাই কোর্ট একটি নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত দিয়েছে, যা পাকিস্তান লিগ্যাল ডিসিশন, ১৯৭৪-এ সন্নিবেশিত রয়েছে। মহিলা আসামি হতে পারেন না। তবে ওই পুরুষটিকে সাজা দিতে হলে অভিযোগকারীকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে ওই মহিলার সঙ্গে যৌনসঙ্গমের সময় আসামি জানতেন অথবা জানার যুক্তিসংগত কারণ ছিল যে যৌনসঙ্গমকারী মহিলা অন্য কোনো ব্যক্তির স্ত্রী।

উল্লেখ্য, কোনো মহিলাকে তার আগের স্বামী তালাক দিয়েছেন এ সরল বিশ্বাসে আসামি বিয়ে করলে তাকে এ ধারার অধীন দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে মহিলার সঙ্গে যৌনসঙ্গম করা হয় সেই মহিলা ওই সময় বিবাহিত না হলে এ ধারার অধীনে কোনো অপরাধ আমলে আনা যায় না। এ ধারার অধীন শাস্তি দিতে হলে বিয়ের বিষয়টি যথাযথভাবে প্রমাণ করতে হয়। তবে লাহোর হাই কোর্ট বলেছে, অবিবাহিত পুরুষ ও স্ত্রীলোক যদি দীর্ঘদিন ধরে একত্রে বসবাস করে তাহলে বলা যাবে না যে তারা ব্যভিচারের অপরাধ করেছে। (পিএলডি ১৯৬২, ৫৫৮)।

সুজনের মামলায় রিতার সেই পরকীয়া প্রেমিক আসামিকে সাজা দিতে হলে সুজনকে পাঁচটি বিষয় অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে। এক. আসামি কোনো নারীর সঙ্গে যৌনসঙ্গম করেছিলেন। দুই. ওই নারী বিবাহিত ছিলেন। তিন. আসামি বিয়ের বিষয়টি জানতেন এবং তা বিশ্বাস করার কারণও ছিল। চার. ওই যৌনসঙ্গম নারীর স্বামীর সম্মতি বা সমর্থন ছাড়াই হয়েছিল। পাঁচ. ওই যৌনসঙ্গম নারী ধর্ষণের শামিল ছিল না। যেহেতু সাক্ষ্য আইনের ১০১ ধারামতে কোনো ঘটনা প্রমাণের দায়িত্ব বাদীর। গোপালচন্দ্র বনাম লাসমত দাসী মামলা যা ৩৪ ডিএলআর, ১৪৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে : বিচার্য বিষয় সম্পর্কে যে পক্ষ কোনো ঘটনার অস্তিত্বের দাবি করে সে পক্ষই তা প্রমাণ করবে। এ মামলায় আসামি যে রিতার সঙ্গে ব্যভিচারী করেছেন, বাদী সুজন প্রমাণ করতে সক্ষম হওয়ায় বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আসামিকে পাঁচ বছরের বিনাশ্রম কারাদন্ড, সেই সঙ্গে অর্থদন্ডেও দন্ডিত করে রায় প্রদান করে।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক ।

সাকিব আহমেদ / ১৯ জানুয়ারি

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সংবাদ অনুসন্ধান ক্যালেন্ডার

MonTueWedThuFriSatSun
22232425262728
2930     
       
  12345
2728     
       
28      
       
       
       
1234567
2930     
       

আমাদের ফেইসবুক পেইজ