বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের শ্রেষ্ঠ উপহার, ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার

প্রকাশিত: ১১:২৬ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৪, ২০২২

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের শ্রেষ্ঠ উপহার, ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার

সিলনিউজ বিডি ডেস্ক :: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিশোর বয়স থেকেই সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে অধ্যয়নকালেই তত্কালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে তিনি প্রথমবার কারাবরণ করেন। সেই থেকে শুরু যেখানেই অন্যায়, সেখানেই শেখ মজুিব। ৪৭-এ দেশ ভাগের পরই তিনি বুঝে ছিলেন এদেশে বাঙালিদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে না। এজন্যই তিনি তার সহকর্মীদের নিয়ে ৪৮ সালে ছাত্রলীগ ও ৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠন করেন। এরপর ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয়দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ মান্ডেট নিয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। তারপর তো ইতিহাস- ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা, নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জাতির পিতা।

বাঙালি জাতির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ৫৫ বছর বেঁচে ছিলেন। এই স্বল্প জীবনের বেশির ভাগ সময়ই এদেশের মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে শাসক শ্রেণির রোষানলে পড়ে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে তাঁকে। যার কারণে প্রায় ১৩ বছরই কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জীবন কাটিয়েছেন তিনি। কারাগারে বসেই কেটেছে জীবনের আটটি জন্মদিন। বঙ্গবন্ধুকে সর্বপ্রথম ১৯৫০ সালে তাঁর ৩১তম জন্মদিন কারাগারে কাটাতে হয়। এরপর ১৯৫১ সালে ৩২তম, ১৯৫৯ সালে ৪০তম, ১৯৬০ সালে ৪১তম, ১৯৬১ সালে ৪২তম, ১৯৬২ সালে ৪৩তম, ১৯৬৭ সালে ৪৮তম এবং ১৯৬৮ সালে ৪৯তম জন্মদিন পাকিস্তানের বন্দিশালায় কাটাতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কখনো আনন্দ উচ্ছ্বাস নিয়ে নিজের জন্মদিন পালন করতেন না। ১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ ৪৮তম জন্মদিনে ‘কারাগারের রোজনামচা’য় তিনি লিখেছেন, ‘আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস!’ জন্মবার্ষিকী তিনি কোনোদিনই নিজে পালন করেননি। বেশি হলে স্ত্রী (রেনু) ওই দিনটাতে একটি ছোট্ট উপহার দিতেন। বঙ্গবন্ধু জেলের বাইরে থাকলে চেষ্টা করতেন জন্মদিনের সময় পরিবারের সাথে থাকতে।

১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫২তম জন্মদিন। ১৬ মার্চ ঢাকায় মুজিব-ইয়াহিয়া দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা শুরু হয়। ১৭ মার্চও সকাল ১০ টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে (বর্তমান রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা) দুই নেতা আবারও বৈঠকে বসেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে পৌঁছানোর পর দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। এক পর্যায়ে একজন বিদেশি সাংবাদিক জানতে চান, আপনার এই জন্মদিনে সবচেয়ে বড় কামনা কী? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ এরপর তিনি আরও বলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না। আমার জন্মদিনে মোমবাতি জ্বালাই না, কেকও কাটি না। আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী!’ এটি ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ জন্মদিন।

১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫৩তম জন্মদিন। স্বাধীন বাংলার মাটিতে জাতির পিতার প্রথম জন্মদিন। সঙ্গত কারণেই বাঙালি জাতির কাছে দিনটি ছিল আবেগ, উচ্ছ্বাস ও আনন্দে ভরপুর। জাতির পিতাও পেয়েছিলেন জন্মদিনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার। ঘটনার প্রেক্ষাপটে একটু পিছন ফিরে তাকাতে হবে। ১৯৭২ সালের ৬ ফ্রেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর ছিল ভারতের কলকাতায়। মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গসহ সমগ্র ভারতবাসী যে অবদান রেখেছিল তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোই ছিল এই সফরের প্রধান উদ্দেশ্য। কলকাতার বিগ্রেড ময়দানে ২০ লক্ষাধিক লোকের জনসমুদ্রে তিনি বক্তৃতা করেছিলেন। সভা শেষে রাজভবনে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনায় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে বঙ্গবন্ধু দু’টি অনুরোধ করেছিলেন। প্রথমত, আমার জন্মদিন ১৭ মার্চ আপনি বাংলাদেশে আসবেন, দ্বিতীয়ত আমি চাই আপনার সফরের আগেই আপনার দেশের সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিবেন। বঙ্গবন্ধুর দু’টো অনুরোধেই শ্রীমতি গান্ধী রেখেছিলেন। তিনি ১৭ মার্চ বাংলার মাটি স্পর্শ করার আগেই ১২ মার্চ বিদায়ী কুচকাওয়াজের মধ্যদিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে।

বিষয়টা মোটেও সহজ ছিল না। এটি একদিকে যেমন ছিল বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ কূটনৈতিক সফলতা, অন্যদিকে ভারত সরকার ও শ্রীমতি গান্ধীর উদারতা। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই, ১৯৪৫ সালে জার্মানিতে ঢুকে মিত্র বাহিনী ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেছিল, এই সময়কালে সেখানে লাখ লাখ মার্কিন, ব্রিটিশ ও রুশ সৈন্য ঘাঁটি গেড়েছিল। যার পরোক্ষ প্রভাব এখনও চলমান। রুশদের পূর্ব জার্মানি ছেড়ে যেতে সময় লেগেছিল ৫০ বছর, হাঙ্গেরিতে ছিল ৪৬ বছর এবং পোল্যান্ড ছিল ৪৮ বছর। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের কয়েকটি দ্বীপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ঘাঁটি গেড়েছিল তা আজও বিদ্যমান আছে। সেখানে স্বাধীনতার মাত্র ৯০ দিনের মধ্যে সদ্য স্বাধীন দেশ থেকে বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহারের ঘটনা ইতিহাসে বিরল।

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ বাংলাদেশে উপস্থিত হন মুক্তিযুদ্ধের অকৃতিম বন্ধু ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। তিনি সমগ্র ভারতবাসীর পক্ষ থেকে ফুল, ফল ও মিষ্টি উপহার দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে এনেছিলেন ভিন্ন এক মাত্রা। শ্রীমতি গান্ধীর সম্মানে বাংলাদেশে সেদিন সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসমাবেশে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বক্তব্যে বলেন, ‘আজকের দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং সুদিনও বটে। কারণ আজ শেখ মুজিবুরের জন্মদিন। তিনি হলেন এদেশের মুক্তিদাতা। আমি তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি।’

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু চারটি জন্মদিন পালনের সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ৫৩তম জন্মদিনটি ছিল তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম জন্মদিন। প্রাণের চেয়ে প্রিয় স্বাধীন মাতৃভূমিতে প্রথম জন্মদিনে শ্রীমতি গান্ধীর কাছ থেকে তিনি সেরা উপহারটাই পেয়েছিলেন। বিজয় লাভের পর এত দ্রুত সম্পূর্ণ মিত্র বাহিনীকে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘটনা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও ঘটেনি।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৭ মার্চ শেষ জন্মদিনটি পালন করেন। সেদিন নেতাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে বাসভবনের দিকে ছিল জনতার স্রোত। ভোর হতেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে প্রিয় নেতার জন্য ফুল নিয়ে উপস্থিত হন হাজার হাজার জনতা। এদিন একটানা চার ঘণ্টা তিনি নেতাকর্মীদের সাক্ষাৎ দেন। বেলা ১১ টার দিকে তিনি বলেন, আমার জন্মদিনে কোন ছুটি ঘোষণা করা হয়নি। অল্প সময়ের জন্য হলেও আমি অফিসে যাব এবং কাজ করবো। আপনারাও সকলে কাজে যান। সেদিন সমগ্র জাতি দিবসটি গভীর শ্রদ্ধার সাথে পালন করে। সরকারি ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং দেশের বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির, গীর্জা ও প্যাগোডায় বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থা করা হয়।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। এখানে নেই কোন দেনা-পাওনার হিসাব। একে অপরের সাহায্যে নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ভারত সরকারও বেশ কিছুপদক্ষেপ নিয়েছে। জন্মশতবার্ষিকীর মাহেন্দ্রক্ষণে ভারত সরকার কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে দেয়া হয় ‘মহাত্মা গান্ধী শান্তি পুরস্কার’। ভারতীয় ডাক বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপর স্মারক ডাকটিকিট এবং বঙ্গবন্ধু-বাপুজি(মহাত্মা গান্ধী) ডিজিটাল প্রদর্শনী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী যৌথভাবে উদ্বোধন করেন।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে গত বছরের ২৬ মার্চ ঢাকায় আসেন ভারতের প্রধানমমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি আসার পূর্বেই বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের জনগণকে লাইফ সাপোর্ট সমদ্ধৃ ১০৯টি অ্যাম্বুলেন্স উপহার দেন। প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে শ্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুরন রহমানকে শ্রদ্ধা জানাই, যিনি সোনার বাংলার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। আমাদের ভারতীয়দের জন্য এটি গর্বের বিষয় যে, আমরা শেখ মুজিবুর রহমান-জীকে গান্ধী শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত করার সুযোগ পেয়েছি। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে উপস্থিত থাকা এবং এমন একটি পুরস্কার তুলে দিতে পারা আমার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলোর একটি।’ তিনি আরো বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সাহস ও তাঁর নেতৃত্ব এটা নিশ্চিত করেছিল যে, কোনো শক্তিই বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’

বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে সশরীরে নেই, কিন্তু তিনি আছেন পুরো বাংলাদেশের অস্তিত্ব জুড়ে । বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শিশুদের খুব ভালোবাসতেন, এজন্য তাঁর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। জন্মদিনের শুভলগ্নে সমগ্র জাতি বিনম্র চিত্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করছে। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, বাঙালি জাতি থাকবে, ততদিন প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন। শুভ জন্মদিনে জাতির পিতাকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : কলামিস্ট ও সাবেক ছাত্রনেতা।

সূত্র : বিডি-প্রতিদিন

সংবাদ অনুসন্ধান ক্যালেন্ডার

MonTueWedThuFriSatSun
  12345
2728     
       
28      
       
       
       
1234567
2930     
       

আমাদের ফেইসবুক পেইজ