মানবাধিকার : আদর্শ মানদন্ডের সন্ধানে

প্রকাশিত: ১২:১৭ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৯, ২০২২

মানবাধিকার : আদর্শ মানদন্ডের সন্ধানে

সিলনিউজ ডেস্ক::করোনা ও বন্যার ধাক্কা সামলে সুখ -দুঃখ মিলেমিশে ২০২১ সাল বাংলাদেশের ভালোই কেটেছে। বাংলাদেশ জন্মলাভের পর থেকে গত ৫০ বছরে এমন কোনো সমস্যা এখনো তৈরি হয়নি যা আমরা নিজেরা সমাধান করতে অক্ষম। এমন কোনো ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেনি যাকে কেন্দ্র করে বাইরের কোনো দেশকে বিচার-সালিশ করার ভার নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রসঙ্গে আমেরিকার দু-একটি সিদ্ধান্ত এ দেশের মানুষকে বিব্রত করেছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আমেরিকা বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ওপর ওই দেশটি ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এমন সিদ্ধান্তের এক সপ্তাহ পার না হতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর রিপোর্ট প্রকাশ করে আমেরিকা বলেছে, গত এক বছরে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। দুনিয়ার ওপর অতিমাত্রায় মোড়লগিরি ফলাতে গিয়ে আমেরিকা সব সময় স্ববিরোধী বার্তা দেয় এ একটি ঐতিহাসিক সত্য। ডিসেম্বরে তারা বাংলাদেশ র‌্যাবের সাতজন অফিসারের আমেরিকা প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে; যে সিদ্ধান্ত কোনো জোরালো যুক্তির ওপর ভিত্তি করে নেওয়া হয়নি। আমরা জানি না র‌্যাবের সাতজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কি আমেরিকা যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদন করেছিলেন? যদি তেমনটি করে থাকেন তাহলে আমেরিকা তাদের ভিসার আবেদন নাকচ করে দিতে পারে। কোনো ভিসাপ্রার্থীর ভিসা মঞ্জুর করা না করা একান্ত সে দেশের একতরফা সিদ্ধান্তের বিষয়। বাংলাদেশের সাত কর্মকর্তার ভিসার আবেদন নাকচ হলে তা আমেরিকা আইন মেনে তাদের নিয়মের মধ্যে অনায়াসে করতে পারে। কিন্তু ভিসাপ্রার্থীদের ভিসার আবেদন নাকচ করার বিষয় সংবাদমাধ্যমকে জানাতে হবে কেন? আর র‌্যাব কর্মকর্তারা যদি আমেরিকা ভ্রমণের জন্য ভিসার আবেদন না করে থাকেন তাহলে আমেরিকা কোন যুক্তিতে ধরে নিচ্ছে যে এ কর্মকর্তারা ভবিষ্যতে আমেরিকা ভ্রমণ করতে পারেন? আমেরিকানরা কল্পনা করে, আমাদের চোখে আমেরিকা এক অনিন্দ্যসুন্দর দেশ। ও দেশে হীরার গাছে মোতির ফুল ফুটে থাকে। তারা ভাবে আমরা সবাই আমেরিকা যাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছি। কয়েকজন বেপরোয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীর মাথা গুনে আমেরিকা যদি একটি দেশকে বিচার করতে চায় তাহলে তাদের এ ভুল ভাঙাবে কে! বাংলাদেশের দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তাদের আমেরিকা ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটি মন্দ উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। তাদের এমন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের কিছু কথা দুনিয়াবাসীর সামনে বলার আছে। ১৭ ডিসেম্বর চীনের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন সাংবাদিকদের সামনে বলেছেন, ‘বর্তমান দুনিয়ায় আমেরিকা সবচেয়ে বড় যুদ্ধাপরাধী। যুদ্ধের নামে দুনিয়াজুড়ে নিরপরাধ সাধারণ মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে তারা ক্রমাগত যুদ্ধাপরাধ করে চলেছে। যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের দায়ে আমেরিকার মিলিটারির বিচার হওয়া উচিত।’ সভ্য দুনিয়া কি চীনের এ অভিযোগ অবিশ্বাস করবে? ২০২১ সালের আগস্টে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে নিল। সেনা নেওয়ার সময় আমেরিকান সেনাদের হত্যাযজ্ঞ থেমে ছিল না। তারা আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার সময় ড্রোন আক্রমণ চালিয়ে ১০ শিশুসহ ১৭ আফগান নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে। দেশটিতে আমেরিকান মিলিটারির এমন হত্যাকান্ড দুনিয়াবাসী জানতে পারার সুবাদে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ও তার প্রশাসন ঘটনার একটি দায়সারা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে। তারা বলছে, আমেরিকান মিলিটারি মনে করেছিল তারা আসন্ন বিপদের মুখে আছে। কাজেই তারা নারী-শিশু বহনকারী গাড়িতে ড্রোন আক্রমণ চালিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে চেয়েছে। আমেরিকার বাইডেন প্রশাসন আরও বলেছে, পেন্টাগন তাদের অপকর্মকারী সেনাদের কখনো বিচারের আওতায় আনবে না। আমেরিকা তার সেনাদের অপরাধের বিচার করে না এটি এখন চিরন্তন সত্যে রূপ নিয়েছে। অথচ আমেরিকা দাবি করে তারা সারা দুনিয়ায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের রক্ষাকর্তা। সে সুবাদে আমেরিকা সারাক্ষণ বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করে যাচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে আমেরিকা প্রতিদিন চীনকে একবার শূলে চড়াচ্ছে যার জবাবে চীন আমেরিকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণ তুলে ধরতে শুরু করেছে। আমরা জানি, আমেরিকা মানবাধিকারের রক্ষক সাজলেও তারা তাদের দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বীরের মর্যাদা দেয়। শুধু তাদের বীর বলে স্বীকৃতি দিয়ে থেমে থাকে না বরং যেসব সাংবাদিক আমেরিকার যুদ্ধাপরাধের সংবাদ দুনিয়াবাসীর সামনে তুলে ধরে তাদের ভাগ্যে জেল-জরিমানা অপরিহার্য। আমেরিকার যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে দুনিয়াকে সত্য জানানোর অপরাধে এ পর্যন্ত কতজন আমেরিকান জেল খেটেছেন কিংবা আমেরিকার নাগরিক না হয়েও দেশটির রোষানলে পড়ে দুনিয়ার বিভিন্ন জেলখানায় ধুুঁকে ধুঁকে মরছেন তার হিসাব কে নেবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার ও তার মিত্র অক্ষশক্তির পরাজয়ের পর পৃথিবীর বহু দেশে আমেরিকান সেনার ঘাঁটি আছে। তারা সেসব জায়গায় কী ধরনের অপরাধ ঘটিয়ে নির্বিচারে পার পেয়ে যাচ্ছে তার একটি উদাহরণ আপনাদের আমি স্মরণ করে দেখতে বলি। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরের ঘটনা। জাপানের ওকিনাওয়ায় আমেরিকান সেনাদের ঘাঁটি থেকে বের হয়ে তিন আমেরিকান সেনা- রেড্রিকো হার্প, কেড্রিক লেডেট ও কাম্প হানসেন ১২ বছরের এক জাপানি কিশোরীকে কিডন্যাপ করে তাদের সেনাঘাঁটিতে নিয়ে গিয়েছিল। তারা ওই মেয়েটিকে নির্মমভাবে ধর্ষণের হত্যা করে। ধর্ষক ও নরহত্যাকারী তিন বিদেশি সেনার বিচার হওয়ার সম্ভাবনা যখন তিরোহিত হতে বসেছিল জাপানের জনগণ আর সহ্য করতে পারেনি। তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। এরপর সেই তিন আমেরিকান সেনার ছয়-সাত বছরের জেল হয়। মেয়াদ শেষে জাপানের জেলখানা থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিন ধর্ষক ও হত্যাকারীর একজন রড্রিকো হার্ফ আমেরিকার সংবাদমাধ্যমে গলা ছেড়ে কেঁদে কেঁদে বলে বেড়াত, জাপানের জেলখানায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। জাপানের জেলখানায় বন্দি থাকাকালে তার মতো একজন আমেরিকান সেনাকে দাসের মতো খাটানো হয়েছে। একজন ধর্ষক, নরহত্যাকারী আমেরিকান সেনার দুঃখের কাঁদুনি শুনে আমেরিকার সরকারি মুখপাত্ররা গলায় দুঃখ ঢেলে বলেছেন, আহা! জগৎ দেখুক। জাপানে মানবাধিকারের কি দুর্দশা।
মানবাধিকার রক্ষা কিংবা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে দুনিয়ার ওপর যুদ্ধ বাধানো পশ্চিমা দেশগুলোর পুরনো চাতুরী। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের কথা স্মরণ করে দেখুন। সে সময় আমেরিকা গায়ে পড়ে যুদ্ধ করতে কোরিয়া গিয়েছিল যেমনটি তারা নিকট অতীতে মধ্যপ্রাচ্যে করেছে। কোরিয়ান যুদ্ধ চলাকালে ১৯৫০ সালে সেখানে একটি রেলওয়ে ব্রিজের পাশে আশ্রয় নেওয়া নারী-শিশু-বৃদ্ধদের আমেরিকান সেনারা ঠান্ডা মাথায় নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এ নারকীয় যুদ্ধাপরাধের ওপর সিরিজ রিপোর্ট প্রকাশ করে।

আমেরিকান সেনাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের এটি একটি ছোট উদাহরণ। আমেরিকা ভিয়েতনামে ২০ বছর যুদ্ধ করেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা ও তাদের ভিয়েতনামি দালালরা কত মানুষ হত্যা করেছিল? ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার যখন যাচ্ছেতাই কোণঠাসা অবস্থা তখন তার সেনারা সেখানকার নারী-শিশু-সিভিলিয়ানদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষের দিকে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল, সাধারণ নিরীহ ভিয়েতনামি নাগরিক হত্যা করতে পারাটাই ছিল আমেরিকান সেনাদের জন্য কৃতিত্বের। আমার শৈশবের স্মৃতি থেকে ভিয়েতনামের মাই লাই হত্যাকান্ডের কথা স্মরণ করতে পারি। এটি ১৯৬৮ সালের কথা। আমেরিকান সেনারা ৫ শতাধিক নিরীহ ভিয়েতনামি নারী-পুরুষ ও শিশুকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল। সে সময় আমেরিকার যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে সারা দুনিয়ায় প্রতিবাদের ঢেউ উঠলে তারা বিচারের নামে প্রহসন সাজিয়ে মাই লাই হত্যার নায়ক আমেরিকান সেনা নরঘাতক উইলিয়াম ক্যালিকে সাত বছরের কারাদন্ড দিয়েছিল। সে কারাদন্ড ভোগের নমুনা শুনুন। উইলিয়াম ক্যালি সাড়ে তিন বছর নামমাত্র গৃহবন্দি জীবন কাটান। তারপর মুক্তবিহঙ্গ। আমি অনুমান করি, উইলিয়াম ক্যালি এখন নিশ্চয়ই ভিয়েতনাম যুদ্ধের বীর বলে আমেরিকা সরকারের বিশেষ ভাতা ভোগ করছেন।

গত শতাব্দীর পুরনো সব কথা বাদ দিলাম। একবিংশ শতাব্দীর দুই দশকে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কত মানুষ হত্যা করেছে? মধ্যপ্রাচ্যে অপরিণামদর্শী আগ্রাসন চালিয়ে আমেরিকা দুনিয়ার কাছে তাদের ন্যূনতম বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। সারা দুনিয়ায় গণমানুষের মনে আমেরিকার ভাবমূর্তি এত নেতিবাচক হলে তাদের জন্য কি সামনে খুব স্বস্তিদায়ক সময় অপেক্ষা করছে?

লেখক : কথাসাহিত্যিক।
সিলনিউজবিডি ডট কম / এস:এম:শিবা

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সংবাদ অনুসন্ধান ক্যালেন্ডার

MonTueWedThuFriSatSun
15161718192021
22232425262728
2930     
       
  12345
2728     
       
28      
       
       
       
1234567
2930     
       

আমাদের ফেইসবুক পেইজ