যে রোগে মানুষ আত্মহত্যা করতে চায়

প্রকাশিত: ১১:৫২ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৮, ২০২১

যে রোগে মানুষ আত্মহত্যা করতে চায়

অনলাইন সংস্করণ
ষোড়শী পরী আজ দু’তিন দিন নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। কারো সঙ্গে কথা বলছেনা চুপচাপ থাকে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। মাঝেমধ্যে অজ্ঞান হয়ে যায়। হাতে পায়ে তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে অজ্ঞান হয়। অনেকটা মৃগী রোগীদের মতো।

জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। আবার অনেক সময় শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে নিঃস্তব্ধ থাকে। হাঁটতে গেলে ধপাস করে পড়ে যায়। সবাই তখন ধরাধরি করে বিছানায় শোয়ায়।

লকডাউনে তাদের কলেজ বন্ধ। বাড়িতে বহুদিন একা একা থাকায় মা খালারা ভাবছেন হয়তো গায়ে উপরি বাতাস কিংবা জ্বীন ভুত আছর করেছে। কবিরাজ, সাধু, সন্যাসী, ভণ্ড পীর সব দেখিয়েছেন। তারা গলায় হাতে, কোমরে, চুলে কয়েকটা তাবিজ ঝুলিয়ে দিয়েছে।

কিছুদিন আগে পাশের বাড়ির একজনের ঠিক এইরকমই সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তারা অনেক চিকিৎসা তদবির শেষ করে বিফল হয়ে এক সময় সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হন। পরবর্তীতে মেয়েটি সুস্থ হয়ে যায়। এ ভেবেই তারা সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে এসেছেন। তবে কি পরীর কোন মানসিক সমস্যা?

চেম্বারে সাইকিয়াট্রিস্ট পরীকে একান্তে অনেক প্রশ্ন করলেন। তাদের পরিবারের সবাইকে একে একে ডেকে সার্বিক জিজ্ঞাসা করলেন।

সাইকিয়াট্রিস্ট নিশ্চিত, পরী মানসিকভাবে দারুণ বিপর্যস্ত। তাই এমন লক্ষণ। নিশ্চয়ই তার মনের ভিতর কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলছে, যা সে কাউকেই বলতে পারছে না, আবার মেনে নিতেও পারছে না। তার মনের এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব এখন শারীরিক উপশমে প্রকাশ পাচ্ছে। এ লক্ষণগুলো যে সে ইচ্ছা করে করছে তা কিন্তু নয়। এ লক্ষণগুলোকে অনেকে হিস্টোরিয়াও বলেন।

চিকিৎসক পরীকে অভয় দিলেন, ‘আমি নিশ্চিত তোমার মনের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি তাকে বুঝালেন সব খুলে না বললে বর্তমান তার মানসিক রোগ থেকে পরিত্রাণ সম্ভব নয়।

অনেকক্ষণ পর পরী মুখ খুললো।

দুলাভাই ক’দিন আগে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। ফোন দেন সময়ে সময়ে। কিন্তু পরীর ধারণা তার দুলাভাই লোকটি ভালো না। এমন কি দুলাভাইয়ের পরিবারের লোকজন ও কেউ ভালো না।

পরীর বোন মারা গিয়েছে মাস ছ’য়েক হলো। তার বোন অন্তঃসত্ত্বা ছিল। কিভাবে কী রোগে পরীর বড় বোন মারা গেলো এটা তারা জানেন না। দুলাভাই ও তার পরিবারের সবাই বলেছে পরী অন্তঃসত্ত্বা ছিলো। অন্তঃসত্ত্বার সময় এক সন্ধ্যায় পরীর বোন পুকুরে গিয়েছিলো কলসি নিয়ে। সেখান থেকে আলাগা বাতাস লেগেছে। এতেই তার মৃত্যু হয়েছে।

কিন্তু পরীর এসব কিছুরই বিশ্বাস হয় না। পরীর ধারণা তার মৃত্যুর কারণ তার দুলাভাই, তার বোনের শাশুড়ি, দেবর ননদ সবাই। তারাই তার বোনকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে মেরেছে।

পরী তার মনের কথা কাউকে বলতে পারছে না। তার উপর দুলাভাই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে।

দুলাভাই লোকটা ভালোনা। বিয়ের পর থেকে তার প্রতি আচরণ, চাহনি ছিলো বিশ্রী। এ গুলো সে কোন মতেই মেনে নিতে পারত না।

পরী এখন কি করবে বুঝতে পারছে না।

পরীর বাবা গরীব দিনমজুর। তাদের ঘরে অভাব। দুলাভাই’রা বড় লোক। পরীর মা বাবা তার দুলাভাইয়ের বিয়ের প্রস্তাবে ‘না’ বা ‘হ্যাঁ’ কিছুই বলতে পারছে না।

দুলাভাই তাকে বিয়ের প্রস্তাবের সময় কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন, পরী নাকি দেখতে অবিকল তার বড় বোনের মতো। তিনি তার মৃত স্ত্রীকে ভুলতেই পারছেন না। তাই পরীকে তিনি ঘরে নিতে চান। মৃত স্ত্রী’কে তিনি ভুলতে চান না। এতে পরীর মা বাবার মন গলেছে।

পরীর ধারণা, তার পরিণতিও তার বোনের মতই হবে। দুলাভাইরা পিশাচ, জানোয়ার শ্রেণির লোক।

ওরা তার বোন’কে তিলে তিলে মেরেছে।

পরী মুখ ফোটে এসব কাউকে কিছু বলতে পারছে না। কেউ বিশ্বাস ও করবে না তাকে।

তার সামনে এখন ভয়াবহ এক বিপদ। সে এসব দ্বন্দ্ব জটিলতা থেকে বাঁচতে আত্মহত্যা করতে চায়। কিন্তু আত্মহত্যা করা ঠিক নয় আত্মহত্যা মহাপাপ। সে কি করবে? এসব মনে হলে তার আর জ্ঞান থাকে না।

পরী মানসিক রোগ কনভারসন ডিসওর্ডারে ভুগছে। রোগটি সাইকিয়াট্রিস্ট, নিউরোলজিস্টদের কাছে আজো বেশ রহস্যময়। তবে এ রোগ ভালো হয়ে যায়। আপনজনের আশা ভরসা আর ভালোবাসায় এ রোগ ভালো হয়। তবে সবার আগে যে কাজ করতে হয় সেটা হলো রোগীর মানসিক সমস্যাটিকে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, ভয়ভীতি ভুলে গিয়ে খুলে বলতে সাহায্য করা।

লেখক: ডা. সাঈদ এনাম

সহকারী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব সাইকিয়াট্রি, সিলেট মেডিকেল কলেজ।
সিলনিউজবিডি ডট কম / এস:এম:শিবা

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সংবাদ অনুসন্ধান ক্যালেন্ডার

MonTueWedThuFriSatSun
  12345
2728     
       
28      
       
       
       
1234567
2930     
       

আমাদের ফেইসবুক পেইজ