ইসলামে সম্প্রীতির শিক্ষা

প্রকাশিত: ৭:১২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৮, ২০২০

ইসলামে সম্প্রীতির শিক্ষা

মাহমুদ আহমদ

ইসলাম শান্তিপূর্ণ ধর্ম। সর্বক্ষেত্রে শান্তির বিধান নিশ্চিত করে প্রেম-প্রীতি, সৌহার্দ্য আর শান্তি ও সম্প্রীতির এক পরিমণ্ডল বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত করাই ইসলামের মূল লক্ষ্য।

ইসলাম মানুষের জীবনে শান্তির এমন বায়ু প্রবাহিত করে যা মানুষের দেহের সুস্থতায়, দৈহিক শক্তি-সামর্থ্যে, তার আত্মায়, সকল ধর্মের সাথে প্রীতিময় সম্পর্ক গড়ে তোলাসহ সর্ব দিক দিয়ে মানুষকে সতেজ করে।

আবহমানকাল থেকে বাংলা ভূখণ্ডে নানা জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্মমতের অনুসারীরা পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে মিলেমিশে একত্রে বসবাসের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বা আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির ঐতিহ্য সংহত রেখেছে।

যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে এটাই ইসলামের শিক্ষা। কেননা একই আদম হাওয়া থেকে আমাদের সবার উদ্ভব। কে কোন ধর্মের অনুসারী তা মূল বিষয় নয়, বিষয় হল আমরা সবাই মানুষ। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই এক জাতি।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘হে মানব জাতি! আমি নর ও নারী থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছি। আর আমি বিভিন্ন গোষ্ঠী ও গোত্রে তোমাদের বিভক্ত করেছি যেন তোমরা একে অপরকে চিনতে পার’ (সুরা আল হুজুরাত, আয়াত: ১৩)।

এই আয়াত বিশ্ব-মানবের ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের মহাসনদ। জাতীয় শ্রেষ্ঠত্ব অথবা বংশগত গৌরবের মিথ্যা ধারণা থেকে উদ্ভূত আভিজাত্যের প্রতি এ আয়াত কুঠারাঘাত করেছে।

এক জোড়া পুরুষ-মহিলা থেকে সৃষ্ট মানবমন্ডলীর সদস্য হিসেবে সকলেই আল্লাহতায়ালার সমক্ষে সমমর্যাদার অধিকারী। চামড়ার রং, ধন-সম্পদের পরিমাণ, সামাজিক মর্যাদা, বংশ ইত্যাদির দ্বারা মানুষের মর্যাদার মূল্যায়ন হতে পারে না।

মর্যাদা ও সম্মানের সঠিক মাপকাঠি হলো ব্যক্তির উচ্চমানের নৈতিক গুণাবলী এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতি তার কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতা। বিশ্ব মানব একটি পরিবার বিশেষ।

জাতি, উপজাতি, বর্ণ, বংশ ইত্যাদির বিভক্তি কেবল পরস্পরকে জানার জন্য, যাতে পরস্পরের চারিত্রিক ও মানসিক গুণাবলী দ্বারা একে অপরের উপকার সাধিত হতে পারে।

মহানবীর (সা.) মৃত্যুর অল্পদিন আগে বিদায় হজের সময় বিরাট ইসলামি সমাগমকে সম্বোধন করে তিনি (সা.) উদাত্ত কন্ঠে বলেছিলেন, ‘হে মানবমন্ডলী! তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদি পিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনো মতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের ওপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।

একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়, কালোও সাদার চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে বিচার্য বিষয় হবে, কে আল্লাহ ও বান্দার হক কতদূর আদায় করলো। এর দ্বারা আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মপরায়ণ’ (বায়হাকি)।
এই মহান শব্দগুলো ইসলামের উচ্চতম আদর্শ ও শ্রেষ্ঠতম নীতি-মালার একটি দিক উজ্জলভাবে চিত্রায়িত করেছে।

শতধা-বিভক্ত একটি সমাজকে অত্যাধুনিক গণতন্ত্রের সমতা-ভিত্তিক সমাজে ঐক্যবদ্ধ করার কী অসাধারণ উদাত্ত আহবান।
ধর্ম নিয়ে যারা আজ অতি বাড়াবাড়ি করছে তাদের কাছে জানতে চাই, ধর্ম কি নৈরাজ্য সৃষ্টির নাম, ধর্মের নাম কি রক্তপাত? মোটেও তা নয়, ধর্ম শান্তির নাম।

ইসলাম সব ধর্মের উপাসনালয়কে শ্রদ্ধা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখারও নির্দেশ দিয়েছে এবং কারো উপাসনালয়ে হামলা চালানোকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। শুধু তা-ই নয় বরং অমুসলিমরা যেসবের উপাসনা করে সেগুলোকে গালমন্দ করতেও আল্লাহপাক বারণ করেছেন।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেছেন- ‘আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা যাদের উপাস্যরূপে ডাকে তোমরা তাদের গালমন্দ করো না। নতুবা তারা শত্রুতাবশত না জেনে আল্লাহকেই গালমন্দ করবে’ (সুরা আন আম: ১০৮)। এ
আয়াতে শুধু প্রতিমা পূজারীদের সংবেদনশীলতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য নির্দেশ দান করা হয়নি বরং সকল জাতি এবং সকল সম্প্রদায়ের মাঝে বন্ধুত্ব এবং সৌহার্দ্য স্থাপনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।

ইসলাম ধর্মের মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব হলো, ইসলাম প্রত্যেক মানুষকে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করে। এই স্বাধীনতা কেবল ধর্ম-বিশ্বাস লালন-পালন করার স্বাধীনতা নয় বরং ধর্ম না করার বা ধর্ম বর্জন করার স্বাধীনতাও এই ধর্মীয় স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘তুমি বল, তোমার প্রতিপালক-প্রভুর পক্ষ থেকে পূর্ণ সত্য সমাগত, অতএব যার ইচ্ছা সে ঈমান আনুক আর যার ইচ্ছা সে অস্বীকার করুক’ (সুরা কাহাফ, আয়াত : ২৮)।

সত্য ও সুন্দর নিজ সত্তায় এত আকর্ষণীয় হয়ে থাকে যার কারণে মানুষ নিজে নিজেই এর দিকে আকৃষ্ট হয়। বলপ্রয়োগ বা রাষ্ট্রশক্তি নিয়োগ করে সত্যকে সত্য আর সুন্দরকে সুন্দর ঘোষণা করানো অজ্ঞতার পরিচায়ক।
ফার্সিতে বলা হয়, সূর্যোদয়ই সূর্যের অস্তিত্বের প্রমাণ। এই নিয়ে গায়ের জোর খাটানোর বা বিতণ্ডার অবকাশ নেই। সূর্যোদয় সত্বেও কেউ যদি সূর্যের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, তাহলে তাকে বোকা বলা যেতে পারে কিন্তু তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কিছুই নেই।

ঠিক তেমনি কে আল্লাহকে মানলো বা মানলো না, কে ধর্ম পালন করলো বা করলো না, এটা নিয়ে এ জগতে বিচার বসানোর কোন শিক্ষা ইসলাম ধর্মে নেই। বরং এর বিচার পরকালে আল্লাহ নিজে করবেন বলে তার শেষ শরীয়ত গ্রন্থ আল কোরআনে বার বার জানিয়েছেন।

এ স্বাধীনতা কাজে লাগিয়ে সমাজে আস্তিকও থাকবে, নাস্তিকও থাকবে। মুসলমানও থাকবে, খ্রিস্টানও থাকবে, হিন্দুও থাকবে এবং অন্যান্য মতাবলম্বীরাও থাকবে।

মহানবী (সা.) সমাজের সর্বক্ষেত্রে এবং সকল জাতির মাঝে শান্তি, শৃংখলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। এমনকি খ্রিস্টানদের নাগরিক ও ধর্মীয়-অধিকারকেও তিনি নিশ্চিত করেছেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত তা যেন বলবত থাকে সেই ব্যবস্থাও করেছেন।

খ্রিস্টানদের নাগরিক ও ধর্মীয়-অধিকার নিশ্চিতকারী মহানবী (সা.) প্রদত্ত ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দের ঘোষণা পত্রে উল্লেখ রয়েছে, ‘এটি মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ (সা.) প্রণীত কাছের এবং দূরের খ্রিষ্টীয় মতবাদ পোষণকারী প্রত্যেকের জন্য ঘোষণা পত্র: আমরা এদের সাথে আছি। নিশ্চয়ই আমি নিজে আমার সেবকবৃন্দ মদিনার আনসার এবং আমার অনুসারীরা এদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি।

কেননা খ্রিস্টানরা আমার দেশের নাগরিক। আর আল্লাহর কসম! যা কিছুই এদের অসন্তুষ্টি ও ক্ষতির কারণ হয় তার ঘোর বিরোধী। এদের প্রতি বলপ্রয়োগ করা যাবে না, এদের বিচারকদেরকে তাদের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা যাবে না আর এদের ধর্মযাজকদেরকেও এদের আশ্রয় থেকে সরানো যাবে না।

কেউ এদের উপাসনালয় ধ্বংস বা এর ক্ষতিসাধণ করতে পারবে না। কেউ যদি এর সামান্য অংশও আত্মসাৎ করে সেক্ষেত্রে সে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গকারী এবং তার রাসুলের অবাধ্য সাব্যস্ত হবে।

নিশ্চয়ই এরা (অর্থাৎ খ্রিস্টানরা) আমার মিত্র এবং এরা যেসব বিষয়ে শঙ্কিত, সেসব বিষয়ে আমার পক্ষ থেকে এদের জন্য রয়েছে পূর্ণ নিরাপত্তা। কেউ এদেরকে জোর করে বাড়ী ছাড়া করতে পারবে না অথবা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতেও এদের বাধ্য করা যাবে না।

বরং মুসলমানরা এদের জন্য যুদ্ধ করবে। কোন খ্রিস্টান মেয়ে যদি কোন মুসলমানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, সেক্ষেত্রে তার (অর্থাৎ সে মেয়ের) অনুমোদন ছাড়া এটি সম্পাদিত হতে পারবে না। তাকে তার গির্জায় গিয়ে উপাসনা করতে বাধা দেয়া যাবে না।

এদের গির্জাগুলোর পবিত্রতা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। এগুলোর সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে বাধা দেয়া যাবে না। আর এদের ধর্মীয় অনুশাসনগুলোর পবিত্রতা-হানী করা যাবে না। এ ঘোষণা পত্র কিয়ামত দিবস পর্যন্ত এই উম্মতের সদস্য লঙ্ঘন করতে পারবে না। [অগ্রপথিক সীরাতুন্নবী (সা.) ১৪১৬ হিজরী, ১০ বর্ষ, ৮ সংখ্যা, ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর প্রকাশনা, ১ম সংস্করণ, আগষ্ট ১৯৯৫]

একটু ভেবে দেখুন, কি চমৎকার শিক্ষা! বিশ্বনবী, মহানবী (সা.) প্রতিষ্ঠিত নীতি হলো, যে যে ধর্মেরই হোক না কেন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের জাগতিক অবস্থান সমান। এটি নিছক একটি ঘোষণাই ছিল না।

বরং মহানবী (সা.) মদিনার শাসনকাজ পরিচালনাকালে এর সুষ্ঠ বাস্তবায়নও করেছিলেন। যারা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে বা যারা একাজে অতি উৎসাহী তাদের জন্য মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণ থেকে একটি সতর্কবাণী উল্লেখ করে শেষ করছি।

মহানবী (সা.) বলেন: ‘হে মানবমণ্ডলী! সাবধান, তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। কেননা তোমাদের পূর্বের জাতিগুলো ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে’ (ইবনে মাজা, কিতাবুল মানাসিক)।

তাই আসুন, ধর্মীয় মতবিরোধ পরিহার করে সকল ধর্মের অনুসারীকে ভালোবসাতে শিখি।

আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী জীবন পরিচালনার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
সুত্র : যুগান্তর

সংবাদ অনুসন্ধান ক্যালেন্ডার

MonTueWedThuFriSatSun
  12345
2728     
       
28      
       
       
       
1234567
2930     
       

আমাদের ফেইসবুক পেইজ