একটি ভাইরাস ও ইতিহাসের বাঁকবদল

প্রকাশিত: ১০:৩৮ অপরাহ্ণ, জুন ২৭, ২০২০

একটি ভাইরাস ও ইতিহাসের বাঁকবদল

ফারহান ইশরাক :;

পৃথিবীর বুকে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে প্রায় দুই মিলিয়ন বছরেরও বেশি সময় পূর্বে। নিজেদের প্রয়োজনে মানুষ তৈরি করেছে সমাজব্যবস্থা, অর্থনৈতিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান।

সৃষ্টির শুরু থেকেই বিভিন্ন প্রভাবক সভ্যতাকে বদলে দিয়েছে। কখনো যুদ্ধ, কখনো বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানুষের স্বাভাবিক জীবনে এনেছে আমূল পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সকল ক্ষেত্রে।

বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার ফল সভ্যতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে, মানুষের সমাজ ব্যবস্থাকে করেছে পুনর্নির্মিত। গত শতাব্দীতেই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে পৃথিবীর মানুষ। যার একটির ভয়াবহতা ছাড়িয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর সব যুদ্ধকে।

এই দু’টি যুদ্ধ বিশ্বব্যবস্থাকে নতুন কাঠামো দান করেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এনেছে আমূল পরিবর্তন। বদল ঘটেছে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রক শক্তির। আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে এই দু’টি ঘটনা মোটাদাগে স্থান করে নিয়েছে।

এর বাইরেও কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা বিশ্বকাঠামোর গতিপথকে বদলে দিয়েছে। যার উদাহরণ হিসেবে গত তিন শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া তিনটি শিল্প বিপ্লবের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কার মানবজাতির ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। এর মাধ্যমেই সূচিত হয়েছে প্রথম শিল্প বিপ্লব।

প্রথম শিল্প বিপ্লবের ফলাফল হিসেবে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে উত্তরণ ঘটেছে মানুষের, পরবর্তীতে যেটির প্রভাব পড়েছে মানুষের সমগ্র জীবনব্যবস্থায়।

এর পরের শতাব্দীতেই আরেকটি বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছে পৃথিবীর মানুষ। দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়েছে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের মাধ্যমে। বিদ্যুতের আবিষ্কার একদিকে যেমন অর্থনীতির উৎপাদন সক্ষমতাকে বৃদ্ধি করেছে, তেমনিভাবে শহরকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোকে করেছে শক্তিশালী।

শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে উদ্ভব ঘটেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির। এই শ্রেণির বিকাশ পৃথিবীর অর্থনীতিতে নতুন গতি এনেছে, বদলে দিয়েছে বৈশ্বিক জীবনধারা।

শিল্প বিপ্লবকে কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু দেশ নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। শক্তিশালী অর্থনীতির মাধ্যমে বিশ্বের বুকে নতুন পরাশক্তির আবির্ভাব ঘটেছে।

মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর গতিবদলকে নতুন মাত্রা দান করেছে তৃতীয় শিল্প বিপ্লব। এটি সংঘটিত হয়েছে বিংশ শতাব্দীতে ইন্টারনেট আবিষ্কারের মাধ্যমে। ইন্টারনেট ও তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতি অর্থনীতিতে এনেছে আমূল পরিবর্তন।

বিশ্বের সর্ববৃহৎ সার্চ ইঞ্জিন গুগল কিংবা মাইক্রোসফটের মতো সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো সমগ্র পৃথিবীর প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর একচেটিয়া ব্যবসার পাশাপাশি মানুষের যোগাযোগব্যবস্থাও নতুন মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে।

ইন্টারনেটের ব্যবহার বিশ্বের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতিও বদলে দিয়েছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো এই বিপ্লবের সুফলকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের অবস্থানকে করেছে আরো সুসংহত।

এভাবে নানা ঘটনাপ্রবাহ পৃথিবীর সামগ্রিক পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। বদলে দিয়েছে সামাজিক আচরণ, অর্থনৈতিক কাঠামো কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থা।

এককালে ব্রিটিশরা পৃথিবীর এক বিশাল অঞ্চল শাসন করেছে। কালের আবর্তনে ব্রিটিশদের সেই সর্বময়ী ক্ষমতা একসময় হারিয়ে যায়। উপনিবেশবাদ বিলুপ্ত হয়ে অসংখ্য নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

নব্য পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় জার্মানি কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো দেশ। আবার তাদেরও বিলোপ ঘটে। বিশ্বের বুকে পরাক্রমশালী দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।

এভাবে সময়ের ব্যবধানে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়েছে পৃথিবী। এই পরিবর্তনগুলো শুধুমাত্র মানুষের জীবণাচরণেই পরিবর্তন আনেনি। বরং এই পরিবর্তনের বিস্তার ছিল সর্বত্র।

এসব পরিবর্তন রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, অর্থনৈতিক কাঠামোর রদবদল ঘটিয়েছে, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার উপর স্থায়ী প্রভাবে ফেলেছে। একটি দেশের সঙ্গে আরেকটি দেশের সম্পর্ক কেমন হবে সেটিও নির্ধারণ হয়েছে এর মাধ্যমে।

বলা যায়, একেকটি পরিবর্তন একেকটি নতুন পৃথিবীর জন্ম দিয়েছে, বিশ্বকে সাজিয়েছে ভিন্নরূপে। পরবর্তীতে পৃথিবীর ইতিহাসে এই পরিবর্তনগুলোই সভ্যতার বাঁকবদল হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

মূলত এটি এক ধরনের ঐতিহাসিক সত্য। একটা নির্দিষ্ট সময় পর পৃথিবীর প্রয়োজনে সমস্ত ব্যবস্থা ওলট-পালট হয়, আবার সময়ের প্রয়োজনে গড়ে ওঠে নতুন কোনো ব্যবস্থা।

এভাবেই বিভিন্ন পট পরিবর্তনের মাধ্যমে সূচিত হয়েছে আমাদের বর্তমান পৃথিবী। তবে এটিও সত্য যে, বিশ্বব্যবস্থার বর্তমান অবস্থান অপরিবর্তনশীল নয়। প্রতিনিয়ত বিশ্বকাঠামোর পরিবর্তন ঘটছে। তবে বড় ধরনের পরিবর্তনের পটভূমি এখন দৃশ্যমান।

হয়তো চলমান মহমারীই একসময় ইতিহাসের বাঁকবদল হিসেবে চিহ্নিত হবে। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে ইতোমধ্যেই পৃথিবীতে লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, সেই পরিবর্তনের আলোকে নতুন বিশ্বকাঠামোর উত্থান এখন সময়ের ব্যবধান মাত্র।

একসময় সামরিক শক্তির মানদণ্ডেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে শক্তিশালী বিবেচনা করা হতো, এখনো হয়। তবে বোধ করি সেই ধারণা বদলের সময় এসেছে।

করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর আমরা দেখেছি, তথাকথিত শক্তিশালী দেশগুলো কীভাবে এই ভাইরাসের আক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে।

ইতালি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে। বরং এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছে ভিয়েতনামের মতো একটি দেশ। এতদিন যাদেরকে পরাক্রমশালী হিসেবে জেনে এসেছিল বিশ্ববাসী, তাদের এহেন অবস্থা সবার বিশ্বাসে ফাটল ধরিয়েছে।

এটি পৃথিবীর মানুষের জন্য একটি বড় বার্তা। বিশ্বশক্তিমত্তার ঐতিহ্যগত যে সামরিক মানদণ্ড ছিল, সেটি খুব শীঘ্রই পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে। একসময় হয়তো স্বাস্থ্যখাতের মাধ্যমেই শক্তিমত্তার বিষয়টি নির্ধারিত হবে।

লকডাউনের কারণে দাফতরিক কাজগুলো প্রযুক্তিগতভাবেই সম্পন্ন করা হচ্ছে। এর সুফল হিসেবে মৌলিক প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন মানুষের সংখা বাড়ছে, তবে এর ফলে কর্মক্ষেত্রেরও সংকোচন ঘটছে।

অফিস-আদালতের কাজ ঘরে বসে সম্পন্ন করতেই অভ্যস্ত হচ্ছেন কর্মজীবীরা, যার দরুণ অফিস রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা দাপ্তরিক কাজের সাথে যারা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন, তাদের চাহিদা কমছে। এর একটি বিরূপ প্রভাব পড়বে চাকরির বাজারে।

এর পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরও বিপুল সংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। ফলাফল হিসেবে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে পড়ছে।

বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার জরিপে দেখা গেছে করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের প্রায় দেড় কোটি মানুষ বেকার হতে চলেছেন।

এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। এই কর্মসংকট শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীজুড়েই চলছে। এর থেকে উতরণের জন্য নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো গঠনের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে বিশ্বের দেশগুলোকে।

দীর্ঘসময় ঘরে থাকার কারণে প্রযুক্তির উপর মানুষের নির্ভরতা দিন দিন বাড়ছে। এতদিন কম্পিউটার বা মোবাইলের যে সফট স্কিলগুলোর কথা মানুষ তাত্ত্বিকভাবে জানতো, তার ব্যবহারিক প্রয়োগ শুরু হয়েছে। করোনার প্রাদুর্ভাব দূর হলেও মানুষের মধ্যে এই অভ্যস্ততা থেকে যাবে।

বলা হয়ে থাকে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আমাদের সন্নিকটে কিংবা ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্রমবর্ধমান ব্যবহার এই বিপ্লবকে আরো ত্বরান্বিত করবে।

বলা যায়, করোনা ভাইরাসের পরবর্তী সময়েই আরেকটি শিল্প বিপ্লব প্রত্যক্ষ করবে পৃথিবীবাসী। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রকে নতুন বিশ্বব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নিয়ে হলে অবশ্যই যথেষ্ট প্রস্তুতি নিতে হবে।

প্রযুক্তিগত দক্ষতায় যেন দেশ পিছিয়ে না থাকে সেটি নিশ্চিত করাই হবে এই বিপ্লবের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

এদিকে ইতিমধ্যেই বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি ক্রমশ কমছে। মন্দা আর শিল্প বিপ্লব নতুন অর্থনৈতিক জোয়ার সৃষ্টি করবে। যার ফলে জেগে উঠবে নতুন কোনো পরাশক্তি।

রাষ্ট্রগুলোর নজর থাকবে স্বাস্থ্যখাতকে শক্তিশালী করার দিকে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়বে প্রতিযোগিতা। সময়ের পরিক্রমায় আবারো একটি বড় ধরনের বাঁকবদলের সামনে পুরো পৃথিবী।

আবারো নতুন সজ্জায় সাজতে যাচ্ছে বিশ্বকাঠামো। আবারো তৈরি হবে নব ইতিহাস। তবে এবারের ইতিহাস কোনো যুদ্ধ-বিগ্রহকে ঘিরে লিখিত হবে না, এবারের ইতিহাস লিখিত হবে করোনাভাইরাসকে ঘিরে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সুত্র : যুগান্তর

সংবাদ অনুসন্ধান ক্যালেন্ডার

MonTueWedThuFriSatSun
15161718192021
22232425262728
2930     
       
  12345
2728     
       
28      
       
       
       
1234567
2930     
       

আমাদের ফেইসবুক পেইজ