রাজনীতিঃ বিরোধী দলও হোক মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের

প্রকাশিত: ২:৫১ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১৮, ২০২১

রাজনীতিঃ বিরোধী দলও হোক মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের

রণেশ মৈত্র

নির্বাচন কমিশনের হিসাবমতে, বাংলাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৩৯ বা ৪০। এর বাইরেও বেশ ভালোসংখ্যক দলের অস্তিত্ব রয়েছে, তারা কমবেশি মাঠে-ময়দানে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জনগণের স্বার্থে স্ব স্ব সাধ্যানুযায়ী কাজ করছে। বেশ কিছু দল নির্বাচন কমিশনের কাছে নিবন্ধনের আবেদন করেছে। কিন্তু অযৌক্তিক আইন-কানুনের দোহাই দিয়ে তা করা হচ্ছে না। সে যাই হোক, দেশটির আকার-আকৃতি অনুপাতে এতগুলো রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী ১৪ দল (বাস্তবে যদিও মাত্র ৫/৬টি দলের সন্ধান পাওয়া যায়) ব্যতিরেকে বাদবাকি সবই তো বিরোধী দল, কিন্তু তাদের অস্তিত্ব ও ক্রিয়াকলাপ আদৌ জনগণের কাছে দৃশ্যমান নয়।

সরকারি দল ও তার জোটে যে দলগুলোর অস্তিত্ব তালিকায় রয়েছে, তার মধ্যেও কিছুসংখ্যক অনিবন্ধিত। এভাবে যদি সরকার-সংশ্নিষ্ট নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ১০টিও হয় (যা কখনোই ঠিক নয়) তবু তার বাইরে আরও ২৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব অন্তত খাতাকলমে রয়েছে। এই ২৯টি দলকে ‘বিরোধী দল’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে, কিন্তু তাদের সরকারবিরোধী বা সরকারের পক্ষে কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় কি?

ইদানীং ফেসবুক হয়ে দাঁড়িয়েছে কোনো কোনো বিরোধী দলের ক্রিয়াকলাপ প্রচারের প্রধান মাধ্যম। সেখানে তাদের আলোচনা-সমালোচনা, মানববন্ধনের ছবি, বিজ্ঞপ্তি মাঝেমধ্যেই দেখা যায়। সংসদে তাদের কোনো স্থান নেই। নিকট অতীতেও ছিল তবে বিগত প্রায় দুটি দশক ধরে সেখানে তাদের আসনের অস্তিত্ব না থাকায় এবং করোনাজনিত কারণে ময়দানে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকায় সরকারি বা বিরোধী কোনো দলকেই গণজমায়েত করতে দেখা যাচ্ছে না বিগত দেড়টি বছর ধরে। কিন্তু তার আগেও কি বিরোধী দলগুলোর সরব অস্তিত্ব জনগণের মধ্যে, মাঠে-ময়দানে খুঁজে পাওয়া যেত? উত্তরটি সরাসরি- ‘না’।

আমরা বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। বিশ্বাসী সুমহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে। তাই বাংলাদেশের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক দলের অস্তিত্ব আমাদের ঐতিহাসিক বাহাত্তরের মূল সংবিধানের পরিপন্থি। সে হিসাবে সরকারি দলকে হতে হবে যেমন বাহাত্তরের সংবিধানে বর্ণিত মূল চার নীতি, যেমন- গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের নিষ্ঠাবান সমর্থক; তেমনই বিরোধী দলগুলোকে অবশ্যই হতে হবে ওই চার মূল রাষ্ট্রীয় নীতির দৃঢ় অনুসারী। তবেই রাজনৈতিক অঙ্গন হয়ে উঠতে পারবে একাত্তরের মহান চেতনাসমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক, সব রকম সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও সমাজতন্ত্রের অনুসারী। গণতান্ত্রিক অধিকারের নাম করে বা তার সুযোগ নিয়ে মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থ রক্ষাকারী পুঁজিবাদের সমর্থক হলে তিনি বা তারা হবেন বিপুল সংখ্যারিষ্ঠ মানুষের স্বার্থবিরোধী এবং বাহাত্তরের মূল সংবিধানের চার মৌলনীতির পরিপন্থি।

রাজনীতি কোনো রাজা-গজার স্বার্থে নয়। গণতন্ত্র তেমন স্বার্থবাদীদের জন্যও নয়। তা পুরোপুরি হতে হবে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের স্বার্থে। এ ক্ষেত্রে সামান্যতম বিচ্যুতি ঘটার বা ঘটানোর কোনো সুযোগ নেই।

এবার আসা যাক বাংলাদেশের সংসদ ও তার রাজনীতির দিকে। সবাই আমরা জানি, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, তা তিনি বা তারা যে দলের প্রতীক নিয়েই নির্বাচিত হয়ে সংসদে যান না কেন, তাদের যে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কথা বলতে হবে, কাজও সেভাবেই করতে হবে। যদি সরকারি দল এবং তাদের কাজকর্ম এর পরিপন্থি কিছু হলে বিরোধী দল তার সমালোচনায় উচ্চকণ্ঠ হবে, তা কি সংসদ কি সংসদের বাইরে।

উদাহরণস্বরূপ, বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মাশ্রয়ী সব দল ও সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু জিয়া-এরশাদই শুধু তার বিপরীতপন্থি কাজ করেছিলেন- তা পূর্ণাঙ্গ সত্য নয়। যেমন ওই সাংবিধানিক বিধান পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সম্পূূর্ণ সংবিধান পরিপন্থি। সে হিসেবে উচিত ছিল ধর্মাশ্রয়ী দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা এবং রাষ্ট্রধর্ম নামে যে সংশোধনী এরশাদ তার ব্যক্তিগত ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার

মতলবে করেছিলেন, তাকেও নির্দি্বধায় বাতিল করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তা করা হয়নি। বরং জিয়া-এরশাদের কুখ্যাত পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীকে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।

প্রকৃতই সংসদে যারা বিরোধী দল হিসেবে নির্বাচিত হয়ে কাজ করছেন, তারা এই মৌলিক বিষয়ে সরকারি দলের ভূমিকার আদৌ কোনো সমালোচনা করছেন না। জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরামের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে আমাদের সংসদে। এরা সবাই বাম গণতান্ত্রিক দল বলে পরিচিত হলেও জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের মতো উগ্র ধর্মান্ধ দলগুলোকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা থেকে অজ্ঞাত কারণে বিরত থাকছেন। ‘রাষ্ট্রধর্ম’ অথবা পঞ্চদশ সংশোধনী, পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী বাতিলের দাবি তোলা থেকেও তারা বিরত। তাই এরা আদৌ বিরোধী দল বলে বিবেচিত হতে পারেন না। এদের মধ্যে জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি ১৪ দলের অন্তর্ভুক্ত থাকায় তাদের চুপ করে থাকার একটি যুক্তি পাওয়া যায়। কারণ তারা আনুষ্ঠানিকভাবেই সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু গণফোরাম? এ দলটি তো ১৪ দলীয় জোটে নেই। এ দলটির মেনিফেস্টোতে স্পষ্টাক্ষরে বাহাত্তরের সংবিধান অবিকল পুনরুদ্ধারের দাবি লিখিত থাকলেও তাদের সংসদীয় ভূমিকায় তার কোনো প্রমাণ মেলে না। সংসদের বাইরেও তারা এ নিয়ে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলছে না। ফলে বঙ্গবন্ধু প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধান আজ কার্যত পরিত্যক্ত। গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. কামাল হোসেন বাহাত্তরের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা। তাই তার কাছে এটি প্রত্যাশিত ছিল না।

বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে গঠিত। এতে ঠাঁই পেয়েছিল একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াত-মুসলিম লীগ প্রভৃতি উগ্র সাম্প্রদায়িক দল। এদের সঙ্গেও বিএনপি জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে জিতে জামায়াতে ইসলামীর দুই শীর্ষ নেতাকে মন্ত্রিত্বের আসন বরাদ্দ করেছিল। তাই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এবং প্রধান বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃত বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাশ্রয়ী দল বলে বিবেচনা করা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অসম্ভব বলে সবাই মনে করেন।

এটা পরিস্কার- দেশকে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে সরকারি দলের ব্যর্থতা ও বিচ্যুতির কঠোর সমালোচনা করার মতো জনগণের আস্থাশীল কোনো বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই। বাংলাদেশের রাজনীতির মূল সংকট এখানেই। আর এ সংকট আমাদের বহুদলীয় সংসদীয় ব্যবস্থাকে সব দিক থেকেই পঙ্গু ও বিবর্ণ করে তুলেছে। পরিণতিতে মানুষ ধীরে ধীরে রাজনীতিবিমুখ অবস্থান নিয়ে আছে। এটি দেশের রাজনীতির জন্য কোনো শুভকর বার্তা বহন তো করেই না, বরং তাকে এক অশুভ লক্ষণ হিসেবেই সবাই বিবেচনা করে।

এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে অম্লান রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধু প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধানকে তার যথাযোগ্য মর্যাদায় পুনর্বহাল করতেই হবে। ওই সংবিধানে বর্ণিত চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে বাংলাদেশের সংবিধানে অবিকৃতভাবে সংযোজনও করতে হবে। কারা করবেন এ কাজগুলো?

একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক
raneshmaitra@gmail.com
সুত্র : সমকাল

সংবাদ অনুসন্ধান ক্যালেন্ডার

MonTueWedThuFriSatSun
15161718192021
22232425262728
2930     
       
  12345
2728     
       
28      
       
       
       
1234567
2930     
       

আমাদের ফেইসবুক পেইজ