এবার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পালা

প্রকাশিত: ৩:০০ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২০, ২০২১

এবার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পালা

আরাফাত মুন্না

১৭ বছর আগে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে চালানো হয়েছিল ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। ২৪ জন নিহত ও ৫ শতাধিক মানুষ আহত হওয়ার ঘটনায় করা দুই মামলায় বিচারিক আদালতে রায় হয়েছে তিন বছর আগে। এবার উচ্চ আদালতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পালা। সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার কারণে উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি শুরুতে কিছুটা বিলম্ব হলেও খুব শিগগিরই বহুল আলোচিত মামলা দুটির ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। শুনানি শুরুতে সব ধরনের প্রস্তুতিও শেষের দিকে। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর দেওয়া বিচারিক আদালতের রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ আসামিকে মৃত্যুদন্ড দেয় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১। একই অপরাধে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ আসামিকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়। আরও ১১ আসামিকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। রায়ে আদালত বলে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী (তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা) শেখ হাসিনাকে হত্যা করে তাঁর দল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করাই ছিল তৎকালীন রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ মদদে চালানো হামলার উদ্দেশ্য। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন জানায়, এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে করা দুই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি গ্রহণে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু পেপারবুক ছাপা শেষ হয়ে গত বছরই সুপ্রিম কোর্টে এসে পৌঁছেছে। হত্যা মামলার ১৩ ভলিউমে মোট ৫৮৫টি এবং বিস্ফোরক মামলার জন্য ১১ ভলিউমে মোট ৪৯৫টি পেপারবুক প্রস্তুত রয়েছে। হত্যা মামলায় ডেথ রেফারেন্সের পাশাপাশি ২২টি আপিল ও ১২টি জেল আপিল দায়ের হয়েছে। অন্যদিকে বিস্ফোরক মামলায় ১৭টি আপিল দায়েরের পাশাপাশি Bangladesh Pratidin১২টি জেল আপিল দাখিল করেছেন আসামিরা। এখন শেষ মুহূর্তের যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। রাষ্ট্রপক্ষ জানিয়েছেন, অতিদ্রুত সময়ের মধ্যেই মামলা দুটি শুনানির উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও স্পেশাল অফিসার বলেন, ‘পেপারবুক আমাদের হাতে রয়েছে। পেপারবুক যাচাই-বাছাইয়ের কাজও শেষ পর্যায়ে। এ কাজ শেষ হলেই বিধি অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ ফৌজদারি কার্যবিধির ৩১ ধারা অনুযায়ী নিম্ন আদালত আসামিকে মৃত্যুদন্ড দিলে তা কার্যকরের জন্য হাই কোর্টের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। মৃত্যুদন্ডের রায় ঘোষণার পর মামলার সব নথি হাই কোর্টে পাঠানো হয়, যা ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে হাই কোর্টে এন্ট্রি হয়। একই সঙ্গে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দন্ডিতরা আপিল ও জেল আপিল দায়ের করেন। ডেথ রেফারেন্স, আপিল ও জেল আপিল একসঙ্গে শুনানি হয়। ডেথ রেফারেন্স শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক তৈরি করতে হয়। পেপারবুকে মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, জব্দ তালিকা, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষীদের জবানবন্দি, জেরা ও বিচারিক আদালতের রায় পর্যায়ক্রমে সাজানো থাকে বলেই জানা গেছে। জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনার কারণে আদালতের কার্যক্রমে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে। অত্যন্ত দ্রুততম সময়ে এ মামলা দুটির পেপারবুক তৈরি হয়েছে। প্রায় ২২ হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সুপ্রিম কোর্টের ছুটি শুরু হচ্ছে। আমরা চাচ্ছি ছুটির আগেই এ মামলার বেঞ্চ নির্ধারণ করতে চাই, যাতে অক্টোবরে শুনানিটা শুরু করা যায়। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আমি অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গেও আলাপ করেছি।’ জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ। খুব শিগগিরই হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে করা দুই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির উদ্যোগ নেব।’ তিনি বলেন, ‘বিচারিক আদালতে খুবই ভালো রায় হয়েছে। হাই কোর্টেও বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজা যাতে বহাল থাকে সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।’

মামলা থেকে বিচার : বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা ঘটে। ওই নৃশংস হামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত ও নেতা-কর্মী-আইনজীবী-সাংবাদিকসহ ৫ শতাধিক লোক আহত হন। অল্পের জন্য বেঁচে যান তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচ- শব্দে তার শ্রবণেন্দ্রিয় আঘাতপ্রাপ্ত হয়। হামলার দিন রাতেই এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় একটি মামলা করেন। পরদিন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মামলা করতে গেলে তা নেওয়া হয়নি। মামলা ভিন্ন খাতে নিতে বিএনপির নীতিনির্ধারক অনেকে সে সময় একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করেন।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পুনর্তদন্ত শুরু হয়। তখন বেরিয়ে আসতে থাকে অনেক অজানা তথ্য। ২০০৮ সালের ১১ জুন সিআইডি কর্মকর্তা ফজলুল কবীর দুটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এতে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজিবি নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। ওই বছরই মামলা দুটি দ্রুত বিচার আদালতে স্থানান্তর করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে হামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পর অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। দুই বছর তদন্তের পর ২০১১ সালের ৩ জুলাই তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করা হয়।

মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ১৯ আসামি হলেন- বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, ডিজিএফআইর সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইর সাবেক ডিজি ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুর রহিম, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ (পলাতক), মাওলানা তাজউদ্দিন (পলাতক), মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মো. আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে মো. ইউসুফ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ, মাওলানা শওকত ওসমান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান, মাওলানা আবু সাঈদ, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ, রফিকুল ইসলাম ও উজ্জ্বল ওরফে রতন।

যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত ১৯ আসামি- তারেক রহমান ওরফে তারেক জিয়া (পলাতক), হারিছ চৌধুরী (পলাতক), শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে আবু ওমর আবু হোমাইরা ওরফে পীরসাহেব, মাওলানা সাব্বির আহমদ ওরফে আবদুল হান্নান সাব্বির, আরিফ হাসান ওরফে সুজন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, আবুবকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম ওরফে আরিফ, মহিবুল মোত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন (পলাতক), আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন (পলাতক), মো. খলিল (পলাতক), জাহাঙ্গীর আলম বদর (পলাতক), মো. ইকবাল (পলাতক), লিটন ওরফে মাওলানা লিটন (পলাতক), কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ (পলাতক), মুফতি শফিকুর রহমান (পলাতক), মুফতি আবদুল হাই (পলাতক) ও রাতুল আহম্মেদ বাবু (পলাতক)।

তিন আইজিপিসহ ১১ জনের দুই ও তিন বছর সাজা : পুলিশের সাবেক আইজি খোদাবক্স চৌধুরী (কারাগারে), সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অব.) রুহুল আমিন (কারাগারে), এএসপি (অব.) আবদুর রশিদ (কারাগারে) ও এএসপি (অব.) মুন্সি আতিকুর রহমানকে (কারাগারে) তিন বছর করে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তাদের ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা হয়েছে। অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদন্ড দিয়েছে আদালত। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক (কারাগারে), সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা (কারাগারে), সাবেক আইজিপি শহুদুল হক (কারাগারে), ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন (পলাতক), লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার (পলাতক), ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক উপকমিশনার ওবায়দুর রহমান (পলাতক) ও ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার খান সাঈদ হাসানকে (পলাতক) দুই বছর করে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাদের ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।
সুত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ