পাথর খনি ডুবছে সিদ্ধান্তহীনতায়

প্রকাশিত: ৮:৫০ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২৩, ২০২১

পাথর খনি ডুবছে সিদ্ধান্তহীনতায়

আন্তর্জাতিক দরপত্রে সাড়া মেলেনি
পাথর খনি ডুবছে সিদ্ধান্তহীনতায়
এ মাসেই শেষ হচ্ছে চুক্তির মেয়াদ, অনিশ্চয়তায় বছরে ১.৮ মিলিয়ন টন পাথর উত্তোলন
মুজিব মাসুদ

মেয়াদ শেষ হলেও রহস্যজনক কারণে মধ্যপাড়া পাথর খনির ঠিকাদার নিয়োগের কোনো সিদ্ধান্ত হচ্ছে না পেট্রোবাংলা। বর্তমানে এই খনি থেকে পাথর উত্তোলন করছে বেলারুশের কোম্পানি জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি)। ২ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। সেক্ষেত্রে হাতে আছে মাত্র ১০ দিন।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়ম অনুযায়ী চুক্তি শেষ হওয়ার কমপক্ষে ৬ মাস আগে পরবর্তী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। এক্ষেত্রে মেগা প্রকল্পটির চুক্তির মেয়াদ বাড়াবে, নাকি আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ অবস্থায় বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশের একমাত্র পাথর খনির কার্যক্রম। এতে পাথর উত্তলন কার্যক্রম বন্ধের আশঙ্কা আছে। ফলে বিপাকে পড়বে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা, মাতারবাড়ী, শহাজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালসহ দেশের মেগা প্রকল্পগুলো। এখান থেকে প্রকল্পগুলোর পাথর জোগান দেওয়া হয়। অন্যদিকে খনি বন্ধ হলে বেকার হবেন সাতশর বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী। একই কারণে বন্ধ হয়ে গেছে পার্শ্ববর্তী বড় পুকুরিয়া কয়লা খনিও। ১০ আগস্ট খনিটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনা সিএমসি-এক্সএমসি কনসোর্টিয়াম চলে গেছে। এখানেও বেকার হয়ে পড়েছেন দুই-তৃতীয়াংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী।

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, মধ্যপাড়া পাথর খনির চুক্তি নিয়ে কাজ চলমান। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এটি চূড়ান্ত হয়ে যাবে। কাজ যাতে বন্ধ না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখেই আমরা কাজ করছি। তিনি বলেন, এই খনির ঠিকাদার নিয়োগে ৭ দফা দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে বিদেশিদের সাড়া মেলেনি। এই অবস্থায় ২ সেপ্টেম্বরের আগেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

অভিযোগ উঠেছে, পেট্রোবাংলা ও এমজিএমসিএলের সঙ্গে যোগসাজশে একটি দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেট এই পাথর খনি নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। চক্রটি চাচ্ছে বড় অঙ্কের কমিশনের বিনিময়ে খনি তৃতীয় কারও কাছে তুলে দিতে। এ কারণেই টানা তিন মেয়াদে লাভজনক খনি থেকে পাথর উত্তোলনের ঠিকাদার নিয়োগ দিতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। সিন্ডিকেট চাচ্ছে এভাবে সময়ক্ষেপণ করে বড় ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে। এতে বর্তমান কোম্পানিটি মেয়াদ শেষে চলে যাবে। এরপর খনি বাঁচানো কিংবা আইনের দোহায় দিয়ে তড়িঘড়ি অন্য কোনো কোম্পানির হাতে খনি তুলে দেওয়া সম্ভব হবে।

জানা যায়, টানা তিন মেয়াদে বেলারুশ কোম্পানিটি প্রায় ৫০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এ কারণে জিটিসির মেয়াদকাল আরও এক দফা বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও সিন্ডিকেট রহস্যজনক কারণে নয়ছয় করছে।

বাংলাদেশ জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) ১৯৭৩-১৯৭৫ সালে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে মধ্যপাড়া এলাকায় ১২৮ মিটার গভীরতায় কঠিন শিলা আবিষ্কার করে। উত্তর কোরিয়ার মেসার্স কোরিয়া সাউথ কোঅপারেশন করপোরেশনের সঙ্গে পাথর খনি উন্নয়নে ১৯৯৪ সালের মার্চে মূল চুক্তি হয়। কয়েক দফা ব্যয় বৃদ্ধির পর ২০০৭ সালের ২৫ মে পাথর খনির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পাথর উত্তোলন কাজ শুরু হয়। কিন্তু লোকসান হচ্ছিল। একপর্যায়ে খনিটি ৫শ কোটি টাকার বেশি লোকসানের বোঝা নিয়ে বন্ধের উপক্রম হয়।

খনিটিকে সচল রাখতে জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি) এবং মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (এমজিএমসিএল) মধ্যে চুক্তি হয়। ২০১৩ সালে ২ সেপ্টেম্বর ৬ বছর মেয়াদি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়। ২০১৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পাথর উৎপাদন শুরু হয়। নানা বাধা পেরিয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রথম লাভের মুখ দেখে। ওই অর্থবছরে প্রায় ৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা লাভ হয়। এরপর থেকে মুনাফা অব্যাহত আছে। এ অবস্থায় ঠিকাদারের মেয়াদ নবায়ন নাকি নতুন কাউকে দেওয়া হবে দায়িত্ব, তা নিয়ে চলছে সময়ক্ষেপণ।

শামসুল আলম নামে এক কর্মকর্তা জানান, ২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত না হলে খনিটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কারণ, বেআইনিভাবে বিদেশিরা এখানে কাজ করবে না। বর্তমানে শতাধিক বিদেশি খনি বিশেষজ্ঞ ও অর্ধশত দেশি প্রকৌশলী এবং ৭৫০ শ্রমিক বর্তমানে এখানে কাজ করছেন।

এদিকে আবু তাহের নামে আরেক খনি প্রকৌশলী যুগান্তরকে বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনার ভয়াবহতার কারণে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খনি বন্ধ করে চলে গেছে। এতে বেকার হয়ে বসে আছেন দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমিক। খনি বন্ধ থাকায় প্রতিদিনই কয়লা খনিতে আন্দোলন চলছে। কাজ না থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন শ্রমিকরা।

এ প্রসঙ্গে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, কয়লা খনি বন্ধ থাকলেও মজুত যা আছে তাতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। তিনি বলেন, খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের জন্য বর্তমান ঠিকাদার কোম্পানি চীনা প্রতিষ্ঠান সিএমসি-এক্সএমসি কনসোর্টিয়ামকে পুনরায় নিয়োগ দেওয়া হবে। তিনি আশা করছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সিএমসি কাজ শুরু করতে পারবে।
সুত্র : যুগান্তর

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ