এন্ড্রু কিশোরের প্রয়াণে নিউইয়র্কে শোকের মাতন

প্রকাশিত: ৫:১৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ৮, ২০২০

এন্ড্রু কিশোরের প্রয়াণে নিউইয়র্কে শোকের মাতন

বিনোদন ডেস্ক :: কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোরের প্রয়াণে নিউইয়র্কে শোকের মাতন চলছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে সর্বস্তরের মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের শোকের প্রকাশ করেছেন। সঙ্গীত জগতের অপূরণীয় ক্ষতির কথা বলে মাতন করেছেন কণ্ঠশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক এবং অনুষ্ঠান আয়োজকরা। ক্যান্সার আক্রান্ত শিল্পীকে বাঁচাতে যারা নিউইয়র্কের সাধারণ মানুষ থেকে অনুদান তুলেছিলেন তারা তাদের অশেষ চেষ্টার কথা বলেছেন।

কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীন বলেন, আমরা দুই যুগের বেশি সময় এক সঙ্গে কাজ করেছি। অডিও, দেশি-বিদেশি কনসার্ট এবং সিনেমায় কণ্ঠ দিয়েছি এক সঙ্গে। তিনি শিল্পী হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী মানুষ হিসেবেও অনুপম। আমরা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করেছি তাকে বাঁচানোর জন্য। তার মৃত্যুর কথা শুনে মনের অজান্তেই চোখে জল এসেছে।

সঙ্গীত পরিচালক ফুয়াদ আল মুক্তাদির বলেন, তিনি শিল্পী হিসেবে কেমন সুপার স্টার ছিলেন এ কথা সবাই জানে। কিন্তু তিনি মানুষ হিসেবে কত বিশাল মনের মানুষ ছিলেন তা কেউ জানে না। আমি তার সঙ্গে ড্রাম বাজিয়েছি। অন্তত ১০০টি শো করেছি গত ২০ বছরে। আমি দেখেছি এত বড় একজন শিল্পী কত নিরহংকারী ছিলেন। জুনিয়র শিল্পীদের তিনি যেভাবে সহযোগিতা এবং সম্মান দেখাতেন তা বলে বর্ণনা করা যাবে না।

অনুষ্ঠান আয়োজক আলমগীর খান আলম বলেন, এমন শিল্পী ১০০ বছরেও জন্মান না। এই ক্ষতি কোনো দিন পূরণ হবে না। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অনন্য। তার কোনো তুলনা হয় না। শো টাইম মিউজিক এবং দেশী মিউজিকের আয়োজন বেবী নাজনীনসহ স্থানীয় শিল্পীরা বিনা পারিশ্রমিকে গান গেয়েছেন এন্ড্রু কিশোরকে বাঁচাতে। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা ও ফুয়াদ আল মুক্তাদির নিজে ফান্ড রাইজ করেছেন। আমাদের সবার চেষ্টায় তাকে বাঁচানো গেলোনা।

বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, এন্ড্রু কিশোর দীর্ঘ ১০ মাস ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শরীরে নানা ধরনের জটিলতা নিয়ে অসুস্থ অবস্থায় গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১৮ সেপ্টেম্বর তার শরীরে নন-হজকিন লিম্ফোমা নামক ব্লাড ক্যানসার ধরা পরে।

সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক লিম সুন থাইয়ের অধীনে তার চিকিৎসা শুরু হয়। সেখানে কয়েক মাস একনাগাড়ে তার চিকিৎসা চলে। চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি নিজের ইচ্ছায় দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি আমার দেশে গিয়ে মরতে চাই, এখানে নয়।’ ১১ জুন বিকেলে সিঙ্গাপুর থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে ফেরেন তিনি। ফিরে যান রাজশাহীতে, যেখান থেকে শুরু। নিজের শহর রাজশাহীর মহিষবাথান এলাকায় বোনের বাড়িতে শেষ হলো তার জীবনের গল্প, পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিলেন তিনি।

বাংলা গানের এই কণ্ঠশিল্পী ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের আধুনিক ও চলচ্চিত্র জগতের কালজয়ী অনেক গান তাঁর কণ্ঠে সমৃদ্ধ হয়েছে। সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দ, প্রেম-বিরহ—সব অনুভূতির গানই তিনি গেয়েছেন। ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর তিনি রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এন্ড্রু কিশোর প্রাথমিকভাবে আবদুল আজিজ বাচ্চুর অধীনে সংগীতের পাঠ শুরু করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, আধুনিক, লোকসংগীত, দেশাত্মবোধকসহ প্রায় সব ধারার গানে কণ্ঠ দেন রাজশাহী বেতারে তালিকাভুক্ত সংগীতশিল্পী হিসেবে। চলচ্চিত্রে এন্ড্রু কিশোর গান গাওয়া শুরু করেন ১৯৭৭ সালে। ‘মেইল ট্রেন’ ছবিতে তিনি গেয়েছিলেন ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানটি। চলচ্চিত্রে এটাই ছিল তার প্রথম গান। সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন আলম খান।
কিন্তু এন্ড্রু কিশোর সবার কাছে পৌঁছে যান দুই বছর পর। তার গানটি ছিল ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’। মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা গানটির সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন আলম খান। দীর্ঘদিন পুরাদস্তুর পেশাদার কণ্ঠশিল্পী হিসেবে দুই বাংলায় গান করেছেন এন্ড্রু কিশোর। একের পর এক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন তিনি।

মাঝে কিছুদিন ব্যবসাও করেছিলেন। এন্ড্রু কিশোর ১৯৮৭ সালে আহমাদ ইউসুফ, আনোয়ার হোসেন বুলু, ডলি জহুর প্রমুখের সঙ্গে টিভি নাটক, বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য প্রযোজনার জন্য ‘প্রবাহ’ নামে একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। এন্ড্রু কিশোরের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘জীবনের গল্প/ আছে বাকি অল্প’, ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যিখানে’, ‘তুমি যেখানে/ আমি সেখানে’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে’, ‘তুমি আমার জীবন/ আমি তোমার জীবন’, ‘ভালো আছি ভালো থেকো’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু ভালোবাসা পেলাম না’, ‘তুমি আমার কত চেনা’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘তোমায় দেখলে মনে হয়’,‘এইখানে দুইজনে নির্জনে’সহ অনেক গান। জীবনের বেশির ভাগ সময়ে মূলত চলচ্চিত্রে গান করেই কাটিয়েছেন।

চলচ্চিত্রে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে অডিও বাজারে খুব একটা অ্যালবাম করেননি। চলচ্চিত্রের বাইরে এসে প্রথম দিকে তিনি ‘ইত্যাদি’তে গান করেন ‘পদ্মপাতার পানি নয়’, যা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীকালে বেশ কয়েকবার ‘ইত্যাদি’তে এসেছেন।

এন্ড্রু কিশোরের এক ছেলে ও এক মেয়ে। তারা দুজনেই অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। মেয়ে মিনিম এন্ড্রু সংজ্ঞা সিডনিতে গ্রাফিক ডিজাইন ও ছেলে জে এন্ড্রু সপ্তক মেলবোর্নে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়াশোনা করছেন। কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দু:খ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোকবার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, এন্ড্রু কিশোর তার গানের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

সংবাদ অনুসন্ধান ক্যালেন্ডার

MonTueWedThuFriSatSun
    123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930 
       
1234567
15161718192021
293031    
       
22232425262728
2930     
       
  12345
2728     
       
28      
       
       
       
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930     
       

আমাদের ফেইসবুক পেইজ