ক্ষমতার দ্বন্দ্বে উত্তপ্ত উপজেলা প্রশাসন

প্রকাশিত: ৯:১৬ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১০, ২০২১

ক্ষমতার দ্বন্দ্বে উত্তপ্ত উপজেলা প্রশাসন

উবায়দুল্লাহ বাদল

ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও নানা ইস্যুতে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা চেয়ারম্যানরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা (ইউএনও) আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। তারা আইন মানছেন না। দাবি আদায়ের জন্য উপজেলা চেয়ারম্যানরা আগামী ১৬ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশ করবেন। প্রয়োজনে আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। অন্যদিকে অধিকাংশ উপজেলা চেয়ারম্যান কর্মস্থলে (নিজ জেলা) থাকেন না, জরুরি প্রয়োজনে তাদের পাওয়া যায় না বলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ দিয়েছেন উপজেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)। এরপর স্থানীয় সরকার বিভাগ চিঠি জারি করে বলেছে, এখন থেকে নিজ নির্বাচনী এলাকায় নিয়মিত অবস্থান করতে হবে উপজেলা চেয়ারম্যানদের। কোনো কারণে নিজ এলাকা বা কর্মস্থল ত্যাগ করতে হলে অনুমতি নিতে হবে। ছুটিসংক্রান্ত বিদ্যমান বিধিমালা মেনে চলার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউএনওরা। ফলে উত্তপ্ত হচ্ছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের অন্যতম শক্তিশালী ইউনিটটি।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমকে তার সরকারি বাসভবনে ঢুকে হামলা করে মারাত্মক আহত করে দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনার পর ইউএনওদের সার্বক্ষণিক গানম্যান ও তাদের বাসভবনের নিরাপত্তায় পুলিশ ও সশস্ত্র আনসার দেয় সরকার। বিষয়টি ভালোভাবে নেননি উপজেলা চেয়ারম্যানরা। তাদের মতে, তারা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাদের নিরাপত্তা না দিয়ে তাদেরই পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নিরাপত্তায় গানম্যান দেওয়া হয়েছে। এটা তাদের জন্য অবমাননাকর। বিষয়টি নিয়ে তারা আদালতের দ্বারস্থ হলে উপজেলা চেয়ারম্যানদের সঙ্গে ইউএনওদের সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়। আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিং, মাসিক সমন্বয় সভাসহ উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন মিটিংয়ে তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিতে থাকে। ১৬ সেপ্টেম্বর উপজেলা চেয়ারম্যানদের ইউএনওদের মতো নিরাপত্তা দেওয়ার নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। একই সঙ্গে উপজেলা পরিষদ ভবনে ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়’-এর পরিবর্তে ‘উপজেলা পরিষদ কার্যালয়’ লেখা সাইনবোর্ড টানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮-এর ধারা ১৩(ক), ১৩(খ) ও ১৩(গ) কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে আদালত। সরকারকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামানের হাই কোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। এর পরই মূলত দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। বিষয়টি ইউএনওরা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও বিভাগীয় কমিশনারদের জানান। ২১ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অনুষ্ঠিত বিভাগীয় কমিশনার সমন্বয় সভায় বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সভায় বিভাগীয় কমিশনাররা বলেন, অনেক উপজেলা চেয়ারম্যান জেলা শহরে বসবাস করেন। কালেভদ্রে তারা নিজ উপজেলায় যান। আবার কেউ কেউ ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করানো বা ব্যবসায়িক কারণে রাজধানীতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ফলে এসব জনপ্রতিনিধিকে সাধারণ মানুষ সহজে পায় না। অনুমতি ছাড়াই তারা খেয়ালখুশিমতো সরকারি গাড়ি নিয়ে সারা দেশ চষে বেড়াচ্ছেন। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বৈঠকে দুটি সিদ্ধান্ত হয়। ওই সিদ্ধান্ত জানিয়ে ২৬ অক্টোবর স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এতে বলা হয়- ‘২১ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অনুষ্ঠিত বিভাগীয় কমিশনার সমন্বয় সভায় তার বিভাগসংশ্লিষ্ট দুটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এক. উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। দুই. যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানরা যেন কর্মস্থল ত্যাগ না করেন সে বিষয়ে মনিটরিং জোরদার করতে হবে।’ এরপর ৩১ অক্টোবর সব উপজেলা চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা জানায় স্থানীয় সরকার বিভাগ। এ ছাড়া ৩ নভেম্বর আবারও চিঠি দিয়ে বিদ্যমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, সদস্য ও মহিলা সদস্যদের ছুটি বিধিমালা ও বিভাগীয় কমিশনারদের সভার সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে অনুসরণ করতে বলা হয়। বিধিমালা অনুযায়ী- সরকারের অনুমতি নিয়ে পরিষদের চেয়ারম্যানরা দাফতরিক ও ব্যক্তিগত কাজে নিজ জেলার বাইরে যেতে বা অবস্থান করতে পারবেন। জরুরি ক্ষেত্রে জেলার সীমানার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে চেয়ারম্যানরা ফ্যাক্স বা টেলিফোনের মাধ্যমে মৌখিকভাবে সরকারের পূর্বানুমতি গ্রহণ সাপেক্ষে ছুটি মঞ্জুর করিয়ে ছুটি ভোগ করবেন এবং ছুটি শেষে লিখিতভাবে ওই ছুটি মঞ্জুর করাবেন।
এ চিঠি পাওয়ার পরই রাজধানীতে প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেয় উপজেলা চেয়ারম্যানদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশন (বিইউপিএ)। ৭ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ইউএনওরা আইন মানেন না বলে অভিযোগ করেন উপজেলা চেয়ারম্যানরা। লিখিত বক্তব্যে বিইউপিএ সভাপতি হারুন অর রশিদ হাওলাদার বলেন, ‘সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। অথচ প্রজাতন্ত্রের প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মচারীরা আইনের চর্চা না করে নির্বাচিত উপজেলা পরিষদকে অকার্যকর করে রেখেছেন, যা শুধু আইন অমান্যই নয় বরং বিভিন্ন স্তরে কর্মরত ২৬টি ক্যাডারের কর্মচারীদের প্রতিও অবহেলা। আমরা আইনের চর্চার পক্ষে। কিন্তু প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মচারীরা আইন অনুসরণ করছেন না। শুধু একটি ক্যাডারের কর্মচারীদের আইন না মানার কারণে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আমরা আজ কর্ম, মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বহীন হয়ে পড়েছি। এমনকি এ ব্যাপারে হাই কোর্ট ১০ কর্মদিবসের মধ্যে রুলের জবাব দিতে নির্দেশনা জারি করলেও কোনো জবাব দেওয়া হয়নি, যা আদালতের প্রতিও অবজ্ঞা।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা ইউএনওদের বিরুদ্ধে নই। জনপ্রতিনিধি ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সঙ্গে আমরা একযোগে আইন অনুযায়ী কাজ করতে চাই। কিন্তু নির্বাহী কর্মকর্তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন।’ সংবাদ সম্মেলনে ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ১১ নভেম্বর থেকে দেশের বিভাগগুলোয় সফর করবেন বিইউপিএর নেতারা। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সঙ্গে মতবিনিময় করবেন তারা। এর মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি না হলে ১৬ জানুয়ারি দেশের সব উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের নিয়ে ঢাকায় সমাবেশ করা হবে। পরে আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি হননি স্থানীয় সরকার বিভাগের কোনো কর্মকর্তা। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্মকর্তারা জানান, ‘জনপ্রতিনিধি হয়েও উপজেলা চেয়ারম্যানরা আইন মানছেন না। কয়েক শ উপজেলা চেয়ারম্যান ঢাকায় এসে সংবাদ সম্মেলন করছেন আইন ভঙ্গ করে। তারা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে কি ঢাকায় এসেছেন? তারা যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন তা বাস্তবায়ন করতে হলে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে। তারা কি অনুমতি নেবেন? এমনকি অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা সারা বছরই ঢাকায় থাকেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। তারা নিয়মিত অফিস না করায় তাদের অধীন দফতরগুলোর ফাইল পেন্ডিং থাকছে। সরকারি গাড়ি উপজেলা পরিষদকে দিলেও তারা সে গাড়ি ব্যক্তিগতভাবেই ব্যবহার করছেন। ভাইস চেয়ারম্যানরা চাইলেও গাড়ি দেওয়া হয় না।’
সিলনিউজবিডি ডট কম / এস:এম:শিবা

সুত্র : বিডি-প্রতিদিন