এক পা কংগ্রেসে, এক পা সংগ্রামে

প্রকাশিত: ৭:৩০ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১৩, ২০২১

এক পা কংগ্রেসে, এক পা সংগ্রামে

আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন

গাজীপুরের স্টাইল ক্র্যাফট গার্মেন্ট কারখানার হাজার হাজার শ্রমিক ছয় মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে দশ দিন ধরে অবস্থান নিয়েছিল বিজয়নগরস্থ শ্রমভবনের সামনের রাস্তায়। নারী শ্রমিকদের অনেকেই অবস্থান নিয়েছিলেন কোলের শিশু সন্তান নিয়ে। মালিকপক্ষ গাজীপুরে স্থানীয়ভাবে লিখিত ও মৌখিক চুক্তি সাতবার ভঙ্গ করেছে।

শ্রম প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে সচিব, আইজি, ডিজি, শিল্প পুলিশ প্রধান, বিজিএমইএ-র সভাপতির উপস্থিতিতে সম্পাদিত দুটি চুক্তিও ভঙ্গ করেছিল মালিকপক্ষ। শ্রমিক-কর্মচারীদের সামনে ভিন্ন কোনো উপায় না থাকায় তারা বকেয়া বেতনের দাবিতে রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা শ্রমভবন ঘেরাও করে বসে ছিল। এমনি লাগাতার আন্দোলনের মধ্যদিয়ে শেষ পর্যন্ত গত ৪ নভেম্বর আংশিক পাওনা আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন স্টাইল ক্র্যাফট গার্মেন্ট শ্রমিকরা। চল্লিশ বছরের অধিককাল আগে শুরু হওয়া গার্মেন্ট শিল্প এখন দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প খাত। ২০২০-২১ অর্থবছরে গার্মেন্টখাতে রপ্তানী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৮ বিলিয়ন বা ৪,৮০০ কোটি ডলার। চল্লিশ বছর আগের ওসি, টেলিভিশনের উপস্থাপকসহ অনেকেই শ্রমিকের ঘাম নিংড়ানো আয় থেকেই হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। ব্যাংক, বীমা, টেলিভিশন চ্যানেল, সংবাদপত্র, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় নাই। তারা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। কেবলমাত্র বকেয়া ঘর ভাড়া দিতে না পারায় স্টাইল ক্র্যাফটের শ্রমিকদের অনেকেরই আশ্রয় জুটেছিল উন্মুক্ত আকাশের নীচে।

৩ নভেম্বর, বুধবার আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাত দিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য প্রতি লিটার ভোক্তা পর্যায়ে ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা পুনঃনির্ধারণ করেছে। ৪ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার এলপি গ্যাসের ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম ৫৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩১৩ টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। জুন মাস থেকে প্রতিমাসে দাম বাড়িয়ে ৮৪২ টাকা থেকে নভেম্বরে ১৩১৩ টাকা করা হয়েছে। গত ছয় মাসে রান্নার গ্যাসের দাম ৫৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। চাল, ডাল, তেল, চিনি, লবণ, মাছ, মাংস, সবজি সবকিছুর দাম বাড়তি। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের পরপরই বাস মালিকরা বাসের ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার ভাড়া এক লাফে ১৪ টাকা বাড়িয়ে ৩৬ টাকা থেকে ৫০ টাকা করা হয়েছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের ননএসি বাসের ভাড়া ৭০ টাকা বাড়িয়ে ৪৮০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকা করা হয়েছে। উপরন্তু বাস মালিকরা বাস ভাড়া বাড়ানোর জন্য দেশব্যাপী মালিক-শ্রমিক ধর্মঘট আহ্বান করেছে। শাহজাহান খানের মত মালিক-শ্রমিক নেতারা নিজেদের স্বার্থে শ্রমিকদের ব্যবহার করছে। পরিবহণ ব্যয় বৃদ্ধির কারণে খাদ্যশস্যসহ সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়বে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলশ্রুতিতে সকল ধরণের পন্যের মূল্যবৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে জনজীবনকে দুর্বিষহ করবে। করোনাকালে বেকার হওয়া, আয় কমে যাওয়ায় দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী পাঁচ কোটি অসহায় মানুষসহ দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষের জীবনে দুর্যোগ নেমে আসবে।

দুর্গাপূজার সময় পূজামণ্ডপ-মন্দির-প্রতিমা ভাঙ্গচুর, লটপাট ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বিরুদ্ধে গত ২-৩ নভেম্বর বাম গণতান্ত্রিক জোটের ‘রোড মার্চ’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালীর চৌমুহনী, লক্ষীপুরের রামগঞ্জ, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জসহ দাঙ্গা পীড়িত এলাকায় এ রোড মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। রোড মার্চে ভারতের সীমান্তবর্তী কুমিল্লায় ত্রিপুরা রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে হিন্দু-মুসলমান উত্তেজনা সৃষ্টি করে ভোট বৈতরণী পার হওয়ার ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারের চক্রান্তের আশংকা যেমন প্রকাশ করা হয় তেমনি আওয়ামী ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন টিকিয়ে রাখতে জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিতে চক্রান্তমূলকভাবে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস উস্কে দেয়ায় সরকারকেও দায়ী করা হয়। হিন্দুদের জান-মাল ও মন্দির-প্রতিমা রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়।

সিপিবি ও বাম গণতান্ত্রিক জোট ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ‘মধ্যরাতের ভোট’-এ অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকা এ সরকারের পদত্যাগ নির্বাচনের দিন থেকেই দাবি করে আসছে। ২০১৪ সালে ৫ জানুযারি ‘বিনা ভোট’-এ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে প্রতিটি নির্বাচনে মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। সিপিবি ও বাম গণতান্ত্রিক জোট মনে করে, এ সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। বাম গণতান্ত্রিক জোট ২০১৯ সালের ১১ জানুয়ারি নির্বাচনোত্তর গণশুনানি থেকে সরকারকে অবৈধ ঘোষণা দিয়ে অবিলম্বে পদত্যাগের দাবি জানিয়ে তদারকি সরকারের অধীনে পুনঃনির্বাচনের দাবি জানিয়েছিল। এ দাবিতে বামজোট অটল রয়েছে। ২০১৪ সালের পর স্থানীয় সরকার নির্বাচনসমূহকে একতরফা নির্বাচনে পরিণত করা হয়েছে। জোর করে প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্বাচন থেকে বিরত রেখে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া অথবা নৌকা আওয়ামী লীগ বনাম বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে নির্বাচনী ওয়াকওভার নেয়া আওয়ামী লীগের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনগুলোতে বিরোধীদলসমূহের বর্জনের প্রেক্ষিতে জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে টাকা দিয়ে বসিয়ে দিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। সদ্য সমাপ্ত কুমিল্লার একটি আসনের উপনির্বাচনে নৌকা মার্কার প্রার্থী প্রখ্যাত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ঘুষ দিয়ে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে বসিয়ে দিয়ে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এভাবেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ব্যবস্থাকে হাস্যকর ও অকার্যকর করে ফেলেছে। মানুষের ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার আওয়ামী দুঃশাসনের পদতলে পিষ্ট হচ্ছে। এ সময়ের মূখ্য সংগ্রাম হচ্ছে ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম।

দেশ থেকে প্রতিবছর ৭০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়। মেগা প্রকল্পের নামে মেগা দুর্নীতি হচ্ছে। আমলা-ব্যবসায়ী-ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা প্রকল্পের বাজেট বৃদ্ধি করে, ঠিকাদার-সরবরাহকারীদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। আমদানিকারক-রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা ওভার ইনভয়েস, আন্ডার ইনভয়েস করে কিক ব্যাকের মাধ্যমে নিজেদের বিদেশি অ্যাকাউন্টে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই দেশের শ্রমজীবী মানুষের কষ্টার্জিত টাকা গুটিকয়েক মানুষ বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। গার্মেন্ট রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ চুঁইয়ে পড়ে খেটে খাওয়া মানুষের উপকারে না লেগে বরং ‘সাইফন’ হয়ে লুটেরাদের বিদেশি ব্যাংক ব্যালেন্স স্ফীত করছে। অর্জিত সম্পদ দিয়ে শিল্প গড়ে বেকারদের কর্মসংস্থান করার পরিবর্তে লুটেরারা সম্পদ লুট করে নিয়ে বিদেশে ‘সেকেন্ড হোম’ আর ‘বেগম পাড়া’ বানাচ্ছে। বাংলাদেশের সমৃদ্ধি, আর সকল মানুষের জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও শোভন কাজের ব্যবস্থা করতে ১ শতাংশ লুটেরাদের লুটপাট ঠেকাতে ৯৯ শতাংশ মানুষের গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা এ সময়ের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক লড়াই।

ব্যবসায়ীদের স্বার্থে সরকারের সহযোগিতায় ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি রোধের লড়াই, দেশের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রীতি রক্ষার সংগ্রাম, জাতির কষ্টার্জিত সম্পদ গুটিকতক ব্যক্তি কর্তৃক আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই এবং দেশের মানুষের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এক ও অভিন্ন সুতোয় গাঁথা। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে হলে গত পঞ্চাশ বছর ধরে চলমান ধারার রাজনীতির অবসান ঘটাতে হবে। আর বর্তমান সময়ের নির্দিষ্ট কাজ হচ্ছে চলমান দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা।

লড়াইয়ের এ প্রেক্ষাপটে আগামী বছরের ১০-১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র দ্বাদশ কংগ্রেস আহ্বান করা হয়েছে। শাখা-উপজেলা-জেলা মিলিয়ে শত শত সম্মেলন শেষে কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে। কংগ্রেস গত পাঁচ বছরের সংগ্রামের মূল্যায়ন করবে, আগামী দিনের সংগ্রামের নির্দেশনা দিবে। গ্রাম-শহরে তৃণমূল পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সম্মেলন ও কংগ্রেসের সাংগঠনিক প্রস্তুতির পাশাপাশি চলমান যে লড়াই-সংগ্রাম তাও সমান তালে জারি রাখতে হবে। কংগ্রেসের জন্য আন্দোলন আবার আন্দোলনের জন্য কংগ্রেসের প্রস্তুতিতে বিঘ্ন ঘটানো যাবে না। দুটোই সমান তালে চালাতে হবে। ‘এক পা কংগ্রেসে, এক পা সংগ্রামে’ এই নীতিতে সকল কমরেডকে ‘ওভার টাইম’ খাটুনির মাধ্যমে কংগ্রেস সফল করতে হবে। পাশাপাশি আওয়ামী দুঃশাসন অবসানের লড়াইকেও অগ্রসর করে নিতে হবে।

লেখক: প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ