সিলেটে প্রাচীন শৈব ভাস্কর্যের সন্ধান

প্রকাশিত: ৭:৫৬ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১৪, ২০২১

সিলেটে প্রাচীন শৈব ভাস্কর্যের সন্ধান

সিলেট শহরে প্রাচীন একটি শৈব ভাস্কর্যের সন্ধান পাওয়া গেছে। পঞ্চমুখলিঙ্গ নামক ভাস্কর্যটির গৌরীপট্টের নলের সম্মুখভাগে রয়েছে বৃষভ মুখ।

গবেষকদের মতে, বৃষভ মুখযুক্ত পঞ্চমুখলিঙ্গ ভাস্কর্যের সন্ধান ইতোপূর্বে পাওয়া যায়নি। গবেষকদের ধারণা, ব্ল্যাক ব্যাসল্ট পাথরে নির্মিত পঞ্চমুখলিঙ্গ ভাস্কর্যটি প্রাচীনকালে সিলেট অঞ্চলের কোনো শৈব বিহারের কেন্দ্রীয় মন্দিরে প্রধান বিগ্রহরূপে পূজিত হতো।

বর্তমানে এটি সিলেট শহরের সুরমা নদীর উত্তর তীরবর্তী কালীঘাট এলাকার কালী মন্দিরে পূজিত হচ্ছে। মন্দিরটি স্থানীয়ভাবে কালী বাড়ি নামেও পরিচিত। শহরের ঐতিহ্যবাহী কালীঘাটের কালী মন্দিরে আরও একটি বিরল প্রাচীন দেবী মূর্তি পূজিত হচ্ছে। মেটালের তৈরি মিনিয়েচার এই ভাস্কর্যটিতে চতুর্ভুজা দেবী শবের উপর পদ্মাসনে উপবিষ্ট।

মূর্তিতত্ত্ববিদদের মতে, মূর্তিটি তান্ত্রিক ঐতিহ্যের। গবেষকদের ধারণা, বৃষভমুখসহ পঞ্চমুখলিঙ্গ এবং শবারূঢ়া দেবী ভাস্কর্য খ্রিষ্টিয় দশম-একাদশ শতকের শিল্পরীতির নিদর্শন।

গত আগস্ট মাসে সিলেট শহরে বিভিন্ন মন্দির আখড়ায় প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে বৃষভমুখসহ পঞ্চমুখলিঙ্গ এবং শবারূঢ়া দেবী ভাস্কর্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়াও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে শহরের কালীঘাট মহল্লার শিববাড়ি, শিববাড়ি মহল্লার বুড়ো শিব মন্দির ও মিরাবাজার মহল্লার বলরাম আখড়ায় আরও ৮টি প্রাচীন শিবলিঙ্গের সন্ধান পাওয়া যায়।

সিলেট শহরে নতুন সন্ধান পাওয়া ভাস্কর্যগুলো মূলত শৈব ঐতিহ্যের। প্রকাশিত কোনো গ্রন্থে বা প্রবন্ধে নতুন সন্ধান পাওয়া ১০টি ভাস্কর্যের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। সিলেট শহরে নতুন সন্ধানপ্রাপ্ত ভাস্কর্যগুলো নিয়ে দেশের মূর্তিতত্ত্ববিদ, শিল্প ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের সঙ্গে কথা হয়। তাদের মতে, শৈব ঐতিহ্যের উল্লিখিত ভাস্কর্য সন্ধান লাভের ঘটনা সিলেটের প্রাচীন ইতিহাস পূনর্গঠনে সহায়তা করবে।

কালী বাড়ির অবস্থান সিলেট নগরীর দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে। সিলেট সিটি করপোরেশনের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে কালীঘাট মহল্লায় আমজাদ আলী সড়কে, সিলেট সার্কিট হাউজ থেকে ৪২১ মিটার পূর্ব দিকে।

স্থানীয়দের মতে, কালী বাড়ি থেকে সুরমা নদী তীরবর্তী মহল্লাটির নাম কালীঘাট হয়েছে। অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ বইয়ে কালীঘাটের কালী মন্দিরটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়, লংলা নিবাসী কালীচরণ ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে ১৮০০ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

মো. মোশারফ হোসেনের ‘হিন্দু জৈন বৌদ্ধ মূর্তিতাত্ত্বিক বিবরণ’ বইয়ে উল্লেখ আছে, গড়নের বিন্যাস অনুযায়ী শিবলিঙ্গ তিন ধরনের। অব্যক্ত (সাদামাটা), ব্যক্ত (পূর্ণাঙ্গ মূর্তি সম্বলিত) ও ব্যক্ত-অব্যক্ত (মুখমণ্ডল বা আবক্ষ মূর্তি সম্বলিত)। কালীঘাটের কালীবাড়ির শিবলিঙ্গটিকে ব্যক্ত-অব্যক্ত শ্রেণির বলা যায়। কারণ এতে শিব, দেবী ও শিবের বাহন বৃষভের শুধু মুখমণ্ডল আছে। কোনো পূর্ণাঙ্গ মূর্তি নেই।

মুখমণ্ডল সম্বলিত শিবলিঙ্গকে মুখলিঙ্গ বলা হয়। মুখলিঙ্গ সাধারণত একমুখলিঙ্গ, তিনমুখলিঙ্গ, চতুর্মুখলিঙ্গ ও পঞ্চমুখলিঙ্গ হয়ে থাকে। তবে পঞ্চমুখ লিঙ্গ বেশ বিরল। পঞ্চমুখ লিঙ্গ ভাস্কর্যে পাঁচটি মুখ থাকে। উপরে শিবের মুখ এবং শিবের মুখের নিচে চারদিকে থাকে চারটি দেবীমুখ। সিলেটের কালীঘাটের কালীবাড়িতে রক্ষিত নন্দীমুখসহ পঞ্চমুখলিঙ্গ ভাস্কর্যের উপরে শিবের মুখ এবং শিবের নিচে চারদিকে রয়েছে চারটি দেবী মুখ। ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১ ফুট ৯ ইঞ্চি। বেদী থেকে গৌরীপট্ট পর্যন্ত উচ্চতা ১১ ইঞ্চি। গৌরীপট্টের দৈর্ঘ্য ১ ফুট ৩ ইঞ্চি।

গবেষক এনামুল হকের লেখা ‘বেঙ্গল স্কালপচারস হিন্দু আইকোনোগ্রাফি আপ টু সি ১২৫০ এ.ডি’ বইয়ে বাংলাদেশ ও ভারতে দুইটি পঞ্চমুখলিঙ্গের সন্ধান পাওয়া কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রন্থে উল্লেখিত দুটি পঞ্চমুখলিঙ্গ ছাড়াও ভারত ও নেপালের হিমালয় অঞ্চলে কিছু প্রাচীন মন্দিরে পঞ্চমুখলিঙ্গ পূজিত হয়ে থাকে। তার মধ্যে ভারতের উত্তরাখণ্ডে রুদ্রপ্রয়াগ জেলায় হিমালয়ের সর্বোচ্চ মন্দির তুঙ্গনাথ মন্দির, উত্তর প্রদেশের মোজাফফরবাদ জেলার পঞ্চমুখী মহাদেব মন্দির, নেপালের পশুপতিনাথ মন্দির অন্যতম। এছাড়াও ভারতের কয়েকটি মিউজিয়ামে বর্তমানে পঞ্চমুখলিঙ্গ ভাস্কর্য রয়েছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ও মূর্তিতত্ত্ববিদ অধ্যাপক মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পঞ্চমুখলিঙ্গ ভাস্কর্য বিরল। কোথাও কোথাও দেখা যায়। সিলেটের পঞ্চমুখলিঙ্গ ভাস্কর্যটি একটি ইউনিক শিল্প নিদর্শন। বৃষভমুখসহ পঞ্চমুখলিঙ্গ ভাস্কর্যের আর কোনো নিদর্শন আছে বলে আমার জানা নাই। দেশে-বিদেশে বহু মিউজিয়ামে গিয়ে প্রাচীন মূর্তি দেখেছি। কোথাও কোথাও পঞ্চমুখলিঙ্গ ভাস্কর্য দেখেছি। সেসব পঞ্চমুখ ভাস্কর্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুগ্ধ প্রবাহের নলের প্রান্তে কোনো মুখ নেই। কোথাও কোথাও নলের প্রান্তে ভারতীয় পৌরাণিক প্রাণী মকরের মুখ দেখা যায়। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত পঞ্চমুখলিঙ্গ ভাস্কর্যটির নলের প্রান্তে প্রাণীর মুখের অবয়ব অস্পষ্ট। এটা কি বৃষভ, না মকর-নিশ্চিত হতে হলে ভাস্কর্যটি নিবিঢ়ভাবে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। কিন্তু সিলেটের পঞ্চমুখলিঙ্গ ভাস্কর্যটি স্পষ্ট। নলের প্রান্তে রয়েছে বৃষভমুখ। শিল্পশাস্ত্র মেনে শিল্পী এটা করেননি, করেছেন তার সৃজনশীলতা, নান্দনিকতাবোধ ও চিন্তা-বিচারশক্তি দিয়ে। ভাস্কর বৃষভমুখ ভাস্কর্যে যুক্ত করেছেন নান্দনিকভাবে। যোনীপট্টের নলের প্রান্তভাগ হয়ে উঠেছে বৃষভমুখ। বৃষভমুখ যুক্ত করায় ভাস্কর্যটি আরও নান্দনিক হয়েছে। পেয়েছে নতুন মাত্রা। বাংলার প্রাচীন ভাস্কর্যের ইতিহাসে এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ নিদর্শন। প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও শৈল্পিক বিবেচনায় ভাস্কর্যটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।’

অধ্যাপক ড. মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া সিলেটের পঞ্চমুখলিঙ্গ ভাস্কর্য সম্পর্কে বলেন, ‘প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধ, শৈব, জৈন ইত্যাদি সম্প্রদায়ের বিহারগুলোর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিহারের কেন্দ্র-প্রাঙ্গণে থাকে একটি কেন্দ্রীয় মন্দির। কেন্দ্রীয় মন্দিরে থাকে প্রধান বিগ্রহ। সাধারণত বড় বিহারগুলোতে কেন্দ্রীয় মন্দিরের চারপাশে থাকে প্রতিমা কক্ষ ও ছোট ছোট কক্ষ। সিলেট অঞ্চলের প্রাচীন কোনো শৈব বিহারের প্রধান মন্দিরে হয়তো পূজিত হতো বর্তমানে সিলেট শহরের কালীবাড়িতে রক্ষিত পঞ্চমুখলিঙ্গটি।’

অধ্যাপক ড. মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া আরও বলেন, ‘নন্দীমুখসহ পঞ্চমুখলিঙ্গ ভাস্কর্যটি স্মরণ করিয়ে দেয় শ্রীচন্দ্র-এর পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনের কথা। মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পশ্চিমভাগ গ্রামে প্রাপ্ত তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টিয় দশম শতকে পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার তৎকালীন শাসক শ্রীচন্দ্র-এর উদ্যোগে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলা এবং ভারতের ত্রিপুরার অংশবিশেষ নিয়ে কয়েকটি বড় আকারের মঠ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। জ্ঞান চর্চা ও পূজা অর্চনার জন্য তখন ৬ হাজার ব্রাহ্মণকে সেখানে বসতি স্থাপন করতে ভূমি দান করা হয়েছিল। এতো বড় অঞ্চল নিয়ে মঠ প্রতিষ্ঠা, একসঙ্গে এতো জন ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করার ঘটনা ভারতবর্ষে বিরল। তখন সিলেট অঞ্চলে তৈরি হয়েছিল অনেক মঠ, বিহার ও মন্দির। সেই সময় অর্থাৎ দশম শতকে বা একাদশ শতকের শুরুতে চন্দ্র রাজবংশের আমলে সিলেট শহরের কালীবাড়িতে রক্ষিত পঞ্চমুখলিঙ্গটি নির্মিত হয়েছিল বলে আমার ধারণা।’

বিশিষ্ট মূর্তিতত্ত্ববিদ ও বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক মো. মোশারফ হোসেন নতুন সন্ধান পাওয়া ভাস্কর্য সম্পর্কে বলেন, ‘পঞ্চমুখলিঙ্গ ভাস্কর্য কম দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু সিলেটের পঞ্চমুখলিঙ্গটি অনন্য। এতে রয়েছে বৃষভমুখ। বৃষভমুখ যুক্ত পঞ্চমুখলিঙ্গ ইতোপূর্বে দেশে বা বিদেশে দেখা যায়নি।’

মো. মোশারফ হোসেন আরও বলেন, ‘সিলেট অঞ্চল সপ্তম শতাব্দিতে ছিল ভাস্কর বর্মার অধীনে। দশম শতাব্দিতে ছিল শ্রীচন্দ্রসহ চন্দ্র বংশের রাজাদের অধীনে। ভাস্কর বর্মা ও শ্রীচন্দ্র বৌদ্ধ ছিলেন। কিন্তু তারা দুজনই শৈবদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং শৈবদের মন্দির ও বিহার নির্মাণে দান করেছেন।’

‘সিলেট অঞ্চলকে বৈষ্ণব অধ্যুষিত অঞ্চল বলা হয়ে থাকে। কিন্তু সম্প্রতি সিলেট শহরে নতুন সন্ধান পাওয়া শৈব ভাস্কর্যগুলো সিলেট অঞ্চলে শৈব ধর্মের বিকশিত হওয়ার সাক্ষ্য বহন করছে। পঞ্চমুখলিঙ্গটি বর্মাদের পরে চন্দ্র বংশদের আমলে নির্মাণ করা হয়েছিল বলে আমার ধারণা,’ বলেন তিনি

কালীবাড়িতে রক্ষিত পঞ্চমুখলিঙ্গটির গৌরীপট্টের নালের দিকে দুই দেবীর মাথায় রয়েছে সর্পচূড়া। কালীবাড়ির সেবাইত মানিক চক্রবর্তী জানান, শিবের মাথায় এবং চার দেবীর মাথায় ছিল সর্পচূড়া। ১৯৯২ সালে মন্দিরটি আক্রান্ত হয়েছিল। তখন বিগ্রহগুলোসহ মন্দিরের জিনিসপত্র বাইরের সড়কে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এ ঘটনায় শিবের মাথার সর্পচূড়া এবং দুই দেবীর মাথার সর্পচূড়া ভেঙে যায়।

কালী বাড়ির সেবাইত মানিক চক্রবর্তী আরও জানান, ‘কালী বাড়িতে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দুটি ছোট প্রাচীন মাতৃমূর্তি পূজিত হতো। এর একটি বর্তমানে মন্দিরে পূজিত হচ্ছে। অন্যটি ছিল মহিষাসুর মর্দিনী মূর্তি। আকৃতিতে দুটি মূর্তি প্রায় একই ছিল। ১৯৯২ সালের পর মহিষাসুর মর্দিনী মূর্তিটি আর পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে বর্তমানে মন্দিরে পূজিত মাতৃ মূর্তিটি অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। কালীবাড়িতে রক্ষিত মাতৃ মূর্তিটির উচ্চতা প্রায় ৩ ইঞ্চি এবং প্রস্থ দেড় ইঞ্চি। চতুর্ভুজ মূর্তিটির উপরের দুই হাত বরদ মুদ্রা ও অভয় মুদ্রায় বিন্যস্ত। নিচের দু’হাতে রয়েছে চক্র ও মুণ্ডু। দেবী গলায় পরেছেন মুণ্ডুমালা। মূর্তিটির প্যাডেস্টাল পদ্ম ফুলের পাপড়ি দ্বারা শোভিত। প্যাডেস্টালের উপর শব এবং শবের উপর দেবী পদ্মাসনে উপবিষ্ট রয়েছেন।’

সিলেটে নতুন সন্ধান পাওয়া দেবী মূর্তি সম্পর্কে অধ্যাপক মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া বলেন, ‘মূর্তিটি হিন্দু বা বৌদ্ধ তান্ত্রিক কোনো দেবী হতে পারেন।’

মূর্তিতত্ত্ববিদ মো. মোশারফ হোসেন বলেন, ‘মূর্তিটির নাম নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। মূর্তিটি ‘দশমহাবিদ্যার মহাকালী’, ‘প্রেতাসনা দেবী’ বা ‘শবারুঢ়া দেবী’ হতে পারে।’

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ইতিহাস বিভাগের সাবেক কিপার ও বাংলার প্রাচীন শিল্পকলা গবেষক ড. নিরু শামসুন্নাহার মনে করেন, মূর্তিটি দশমহাবিদ্যার মহাকালী হওয়ার সম্ভবনাই বেশি।

শাস্ত্রে দেবীর আয়ুধ খড়গ ও মুণ্ডু। কালীঘাটের কালীবাড়িতে পূজিত দেবীর হাতে আয়ুধ রয়েছে চক্র ও মুণ্ডু। এ প্রসঙ্গে ড. নিরু শামসুন্নাহার বলেন, ‘পূর্ব বাংলার প্রাচীন প্রতিমা শিল্প পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শিল্পীরা সব সময় শিল্পশাস্ত্র অনুসরণ করে মূর্তি নির্মাণ করেননি। কখনো কখনো শিল্পীরা সৃজনশীলতার প্রয়োগ ঘটাতেন। তাদের নিজস্ব শিল্পসত্ত্বার প্রয়োগ করতেন। শিল্পীর নিজস্ব শিল্পসত্ত্বার প্রকাশের স্বাধীনতা পূর্ববঙ্গে ছিল। এ বৈশিষ্টটি পূর্ববঙ্গের প্রাচীন ভাস্কর্য শিল্পকে ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পৃথক করেছে। পণ্ডিতেরা এ অঞ্চলের প্রাচীন ভাস্কর্য শিল্পকে পূর্বীশৈলী বলে উল্লেখ করেছেন। সিলেটের কালী মন্দিরে রক্ষিত দেবী মূর্তিটির হয়তো দশমহাবিদ্যার মহাকালী। মূর্তিটিতে খড়গের পরিবর্তে চক্র থাকা ছাড়া আর সব বৈশিষ্ট্য মহাকালীর। শিল্পী হয়তো মহাকালী মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। মহাকালীর এক হাতে খড়গের পরিবর্তে শিল্পী দিয়েছিলেন চক্র।’

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সিলেট জেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি গোপিকা শ্যাম পুরকায়স্থ জানান, কালীবাড়িতে কবে থেকে প্রাচীন ভাস্কর্যসমূহ রক্ষিত ও পূজিত হচ্ছে- এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো সময়কাল জানা যায় না।

তিনি আরও জানান, ২০১৭ সালে জেলা প্রশাসনের আদেশে সিলেট শহরের দুটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব সনাতন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির অধীনে আনা হয়। মন্দিরের পূজা-অর্চনা এবং সেবাইতের দায়িত্ব পালন করার অধিকার সংক্রান্ত দলিল জমা দেয়ার পর দুটি প্রতিষ্ঠানে সেবাইত প্রথা অব্যাহত থাকে। কালীঘাটের কালী মন্দির ও শিব মন্দির এর অন্যতম।

সুরমা নদী তীরবর্তী কালীঘাট মহল্লাটি এখন নগরীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা। অঞ্চলটিতে গড়ে উঠেছে চাল, ডাল, তেল, গুড়, পেঁয়াজসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের পাইকারি বাজার। গোপিকা শ্যাম পুরকায়স্থ জানান, কালীবাড়ির কারণে অঞ্চলটির নাম হয়েছে কালীঘাট। কালীমন্দির ও শিব মন্দিরের পাশে ছিল উন্মুক্ত চত্বর, সপ্তাহে দুদিন বসতো হাট। তবে বর্তমানে যা অবস্থা, মনে হয় এখানে সাত দিনই বসে হাট।

কালীবাড়ির মতো শিববাড়িতে রক্ষিত ভাস্কর্যসমূহ কবে থেকে পূজিত হচ্ছে-এ বিষয়ে তথ্য পাওয় যায় না। কালীঘাটের কালীবাড়ি এবং শিববাড়ির সেবাইত মানিক চক্রবর্তী জানান, তিনি তার পিতামহের কাছে শুনেছেন, তার পিতামহ শৈশব থেকেই কালীবাড়ি ও শিববাড়িতে পূজিত প্রাচীন মূর্তি দেখে আসছেন।

কালীঘাট মহল্লার শিববাড়িতে রয়েছে ছয়টি শিবলিঙ্গ। শিববাড়ি মন্দিরে সারিবদ্ধভাবে স্থাপন করা আছে প্রাচীন শিবলিঙ্গগুলো। শিববাড়িতে রক্ষিত ভাস্কর্যের মধ্যে প্রথম শিবলিঙ্গটির উচ্চতা সাড়ে ১০ ইঞ্চি। বেদী থেকে গৌরীপট্ট পর্যন্ত উচ্চতা ৪ ইঞ্চি। গৌরীপট্টের দৈর্ঘ্য ১ ফুট। দ্বিতীয় শিবলিঙ্গটির উচ্চতা ১১ ইঞ্চি। বেদী থেকে গৌরীপট্ট পর্যন্ত উচ্চতা সাড়ে ৩ ইঞ্চি। গৌরীপট্টের দৈর্ঘ্য ১ ফুট ৯ ইঞ্চি। তৃতীয় শিবলিঙ্গটির উচ্চতা ১ ফুট ২ ইঞ্চি। বেদী থেকে গৌরীপট্ট পর্যন্ত উচ্চতা ৬ ইঞ্চি। গৌরীপট্টের দৈর্ঘ্য ১ ফুট ২ ইঞ্চি। চতুর্থ শিবলিঙ্গটির উচ্চতা ১ ফুট আড়াই ইঞ্চি। বেদী থেকে গৌরীপট্ট পর্যন্ত উচ্চতা ৮ ইঞ্চি। গৌরীপট্টের দৈর্ঘ্য ১ ফুট। পঞ্চম শিবলিঙ্গটির উচ্চতা ১ ফুট সাড়ে ৩ ইঞ্চি। বেদী থেকে গৌরীপট্ট পর্যন্ত উচ্চতা সাড়ে ৪ ইঞ্চি। গৌরীপট্টের দৈর্ঘ্য ১ ফুট সাড়ে ৪ ইঞ্চি। ষষ্ঠ শিবলিঙ্গটির উচ্চতা ২ ফুট ১০ ইঞ্চি। বেদী থেকে গৌরীপট্ট পর্যন্ত উচ্চতা সাড়ে ১১ ইঞ্চি। গৌরীপট্টের দৈর্ঘ্য ১ ফুট সাড়ে ৪ ইঞ্চি।

নগরীর ২০ নম্বর ওয়ার্ডে শিববাড়ি মহল্লার বুড়াশিববাড়ি মন্দিরে পূজিত হয়ে আসছে একটি প্রাচীন শিবলিঙ্গ। বুড়াশিব মন্দিরে রক্ষিত শিবলিঙ্গটির উচ্চতা ২ ফুট ৯ ইঞ্চি। গৌরীপট্টের দৈর্ঘ্য ২ ফুট ৬ ইঞ্চি। বুড়াশিব বাড়িতে একটি প্রাচীন বৃক্ষের নিচে শিবলিঙ্গটি পূজিত হতো। ২০০৪ সালে নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠা করে মন্দিরের মাঝে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শিবলিঙ্গটি। এই শিবলিঙ্গটিতে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা সাধারণত দেখা যায় না। বুড়াশিব বাড়িতে রক্ষিত শিবলিঙ্গে যোনীপট্টের নল থেকে বেদী পর্যন্ত রয়েছে পাথর, যা অনেকটা খুটির মতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিল্পের ইতিহাসের শিক্ষক দীপ্তি রানী দত্ত সিলেটে নতুন সন্ধান পাওয়া ভাস্কর্য প্রসঙ্গে বলেন, সিলেটে নতুন সন্ধান পাওয়া শিবলিঙ্গের মধ্যে শিববাড়িতে রক্ষিত প্রথম শিবলিঙ্গটিকে সবচেয়ে প্রাচীন মনে হয়। এটিতে যোনী ও লিঙ্গ সমগুরুত্বে উপস্থাপিত। কিন্তু শিববাড়ির তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম শিবলিঙ্গ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, সেখানে যোনী অংশের গুরুত্ব ক্রমশ কমছে। গৌরীপট্টকে বৃষভতে রূপান্তরিত হওয়ার যে ক্রম বিবর্তন তা থেকে গৌরীপট্ট তথা নারীর সামাজিক ক্ষমতাকাঠামোতে গুরুত্ব কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে তা পাঠ করার সুযোগ আছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ও মূর্তিতত্ত্ববিদ অধ্যাপক মোজাম্মেল হক বলেন, সিলেট শহরে সন্ধান পাওয়া শৈব ভাস্কর্যগুলো সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্য চর্চার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দলিল। অধ্যাপক হক আরও বলেন, সিলেট অঞ্চলটি বৈষ্ণব অধুষ্যিত অঞ্চল বলে পরিচিত। সম্প্রতি শৈব ভাস্কর্যের সন্ধান পাওয়ার ঘটনা থেকে ধারণা করা যাচ্ছে, বৈষ্ণব মতবাদ চর্চার পাশাপাশি শৈব মতবাদও সেখানে বিকাশ লাভ করেছিল।

অধ্যাপক মোজাম্মেল হক আরও বলেন, সিলেট শহরে নতুন সন্ধান পাওয়া ভাস্কর্যের মধ্যে পঞ্চমুখলিঙ্গ ভাস্কর্যটি ব্ল্যাক ব্যাসল্ট পাথরে নির্মিত। অন্য শিবলিঙ্গগুলো স্থানীয় তথা মেঘালয়, ত্রিপুরা, সিলেট ইত্যাদি অঞ্চলের পাথরে নির্মিত ধারণা করা হচ্ছে।
সূত্র: ডেইলি স্টার

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ