বিশ্বনাথে অফিস সহকারীর রহস্যঘেরা ‘আত্মহত্যা’, পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

প্রকাশিত: ৯:১২ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৪, ২০২০

বিশ্বনাথে অফিস সহকারীর রহস্যঘেরা ‘আত্মহত্যা’, পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

বিশ্বনাথ সংবাদদাতা ::
সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর ‘আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের’ অফিস সহকারী আসমা শিকদার সিমলা (৪০)’র হারপিক খেয়ে আত্মহত্যায় ঘটনায় এলাকায় রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে আসমার পিতা এবং স্বামীর বাড়ির লোকজন ও স্কুল কমিটির নেতৃবৃন্দ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছেন।

এদিকে আসল ঘটনাকে আড়াল করে তৃতীয় একটি পক্ষ এ বিষয়কে কেন্দ্র করে স্কুল ধ্বংস করার পায়তারা করছে বলেও অভিযোগ করেছে। এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়েরের ফলে এলাকার বিরাজ করছে গ্রেপ্তার আতংঙ্ক।

আসমার আত্মহত্যার পর তার স্বামী দৌলতপুর ইউনিয়নের বাহাড় দুভাগ গ্রামের ফজলুর রহমান বাদী হয়ে স্কুলের গভর্নিং বডির ২ সদস্য ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের নাম উল্লেখসহ আরো ৭ জনকে অজ্ঞাতনামা অভিযুক্ত করে থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার অভিযুক্তরা হলেন- স্কুল গভর্নিং বডির সভাপতি দৌলতপুর গ্রামের যুক্তরাজ্য প্রবাসী, মুক্তিযোদ্ধা এম এ রউফ (৬৫) ও সদস্য আনোয়ার মিয়া (৪৫), ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার চরশ্রীরামপুর গ্রামের হাসিম উদ্দিন (৬০)। ইতোমধ্যে আনোয়ার মিয়াকে গ্রেপ্তার করে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।

আসমার (পিতা-স্বামীর) পরিবারের দাবী- আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের বিগত ৩ বছরের হিসাব দেওয়ার জন্য ১৮ জুন গঠিত প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির কয়েকজন সদস্য অফিস সহকারী আসমা শিকদার সিমলাকে চাপ প্রয়োগ ও একাধিকবার অপমান করেন। এমনকি নিজেদের পছন্দের মানুষকে চাকরি দেওয়ার জন্য কলেজ শাখার অফিস সহকারীর পদ থেকে আসমাকে বাদ দেওয়া হয়। আর এসব অপমান সহ্য করতে না পেরে আসমা ৬ জুলাই ২.১৫ মিনিটের দিকে নিজ বাসার (ভাড়াটিয়া) বাতরুমে আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে হারপিক পান করেন। এরপর সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ জুলাই ভোররাতে আসমা মৃত্যুবরণ করেন।

তবে স্কুল কমিটির দাবী- পারিবারিক কলহের জের ধরে প্রায় ১০ মাস পূর্বে স্বামী-সন্তানসহ আসমাকে নিজ বাড়ি থেকে বের করে দেন তার (আসমা) দেবর ও স্থানীয় ওয়ার্ডের মেম্বার তালুকদার শাহীন আহমদ। বিগত ঈদের দিন আসমা স্বামী-সন্তান নিয়ে বাড়িতে গেলে তাদেরকে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করেন দেন শাহীন। যা আসমা নিজ মুখে গভর্নিং বডির অনেককে বলেছেন। আর পারিবারিক কলহ চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকার কারণে মৃত্যুর পরও স্বামীর বাড়ির কবরস্থানে আসমার লাশ দাফন করা হয়নি, হয়েছে পিতার বাড়ির কবরস্থানে। আর বিধিমতে প্রতিষ্ঠানের হিসাব সাবেক কমিটি বর্তমান কমিটির কাছে হস্তান্তর করবে, এখানে অফিস সহকারীর কাছে হিসাব চাওয়া অযৌক্তিক ও অবৈধ। যদি গভর্নিং বডির নেতৃবৃন্দ তার সাথে বার বার ওই অবৈধ ও অযৌক্তিক কাজ করে থাকেন তা হলে তিনি (আসমা) কেন বিষয়টি উনার দেবর (শাহীন) ও স্থানীয় মেম্বার বা চেয়ারম্যান বা এলাকার গন্যমান্য বা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বা ইউএনও’র কাছে অভিযোগ অথবা তাদেরকে অবহিত করলেন না। তারা (ফজলুর-আসমা) স্বামী-স্ত্রী ছাড়া প্রতিষ্ঠানের হিসাবের জন্য চাপ প্রয়োগ করার ব্যাপারে আর কেউ জানেন না।

আসমার স্বামী ফজলুর রহমান বলেন, আমাদের পারিবারিক কোন কলহ নেই। স্কুলে যাতায়াতের সুবিধার জন্য স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাসা ভাড়া নিয়েছি। আমার ভাই কর্তৃক বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগটি মিথ্যা-বানোয়াট। আসমা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের একটি দুর্নীতি ধরে দিলেও গভর্নিং বডি তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বরং আমার (ফজলুর) সামনেই গভর্নিং বডির সদস্য আনোয়ার আসমাকে চড় মেরে দাঁত ফেলে দেওয়ার হুমকি দেন এবং হিসাব ঠিক না থাকলে তার পিতার গলায় চাপ দিয়ে টাকা উদ্ধার করার হুমকি দেন সভাপতি। অধ্যক্ষের দুর্নীতি যাতে প্রকাশ না পায় সেজন্য আসমাকে কলেজ শাখার অফিস সহকারীর পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়। আমরা চেয়েছিলাম বাইরের কাউকে না জানিয়ে বিষয়টি শেষ করতে, আর তাই নিজেদের সম্মান রক্ষার জন্য কাউকে এ ব্যাপারে জানানো হয়নি।

স্থানীয় সাংবাদিকদের একটি দল সোমবার সরেজমিনে এলাকায় গেলে উভয় পক্ষের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ পেলেও প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাসিম উদ্দিনের দেখা পাননি। তবে এ ঘটনায় যাতে কাউকে অযথা হয়রানি না করা হয় সেজন্য প্রশাসন ও সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করে সুষ্ঠ তদন্তের দাবী জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সদস্য কর্তৃক অফিস সহকারী আসমা শিকদার সিমলাকে অবৈধভাবে হিসাব দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করার ব্যাপারে তার (আসমা) মৃত্যুর পূর্বে জানতেন না বা জানানো হয়নি বলে স্বীকার করেছেন আসমার দেবর ও স্থানীয় মেম্বার তালুকদার শাহীন আহমদ, যুক্তরাজ্য প্রবাসী ছোট ভাই স্বপন শিকদার। তবে সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে অপরাধীর শাস্তি দাবী করেন তারা।

নব-গঠিত কমিটির ৩ সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য জামাল উদ্দিন বলেন, প্রতিবেশি হওয়ার সুবাধে প্রতিদিন ৪/৫ বার তাদের (আসমা-ফজলুর) সাথে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু কোন দিনই তাদের মুখে প্রতিষ্ঠানের হিসাবের জন্য নতুন কমিটির সদস্য কর্তৃক তাকে অবৈধ চাপ প্রয়োগের কথা শুনি নি। আসমার আত্মহত্যা করার আসল রহস্য উদঘাটন হওয়া জরুরী।

আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি যুক্তরাজ্য প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা এম এ রউফ বলেন, ‘আসমা আমার মেয়ের মতো হওয়াতে সে প্রায়ই নিজের পারিবারিক কলহের কথা আমাকে বলত। নিজেও মানসিক চাপে ভোগতো। তাই আমি তাকে নিজের সাধ্যমতো শান্তনা দিতাম। প্রতিষ্ঠানের হিসাব তার কাছে যাওয়া বা এজন্য তাকে চাপ দেওয়া একটি অবৈধ কাজ। আর আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন অবৈধ কাজ করতে পারি না। পূর্বের কমিটি আমাদের কাছে ৪ বছরের হিসাব হস্তান্তর করতে চেয়েছিলেন। আমরা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য ৬ সদস্য বিশিস্ট একটি অডিট কমিটি গঠন করে তদন্ত করাচ্ছি। তবে তাকে কিভাবে চাপ দিলাম। আসমার আত্মহত্যার জন্য তার স্বামী (ফজলুর) দায়ী। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে। আর সে (ফজলুর) নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা-বানোয়াট মামলা করেছে। এছাড়া একটি পক্ষ তাকে ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা করছে। তাছাড়া শুনেছি পারিবারিক কলহের কারণে ইতিপূর্বে আরো দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে আসমা।’

এ ব্যাপারে গ্রেপ্তারকৃত আনোয়ার মিয়ার স্ত্রী সুরমা আক্তার শিবলী বলেন, আমার স্বামী উনার (আসমা) সাথে খারাপ আচরণ করলে কি আর স্বামী-সন্তান নিয়ে তিনি (আসমা) আমাদের বাড়িতে দাওয়াতে (৩ জুলাই) আসতেন। পারিবারিক কলহের জের ধরেই আসমা আত্মহত্যা করেছেন। আর তার স্বামী নিজেকে বাঁচাতেই স্কুল কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। শুনেছি পারিবারিক কলহের কারণে ইতিপূর্বে আরো দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন আসমা।

বিশ্বনাথ থানার অফিসার ইন-চার্জ (ওসি) শামীম মুসা বলেন, বিষয়টি নিয়ে পুলিশী তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। আর সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে প্রকৃত অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা হবে। এ ঘটনায় কাউকে হয়রানি করা হবে না।

এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজামান ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সমীর কান্তি দেব বলেন, প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সদস্য কর্তৃক অফিস সহকারী আসমা শিকদার সিমলাকে অবৈধভাবে হিসাব দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করার ব্যাপারে তার (আসমা) মৃত্যুর পূর্বে কেউ কোন অভিযোগ করেননি, এমনকি অবহিতও করেননি।