নমপেন থেকে দূরে রেললাইনের পাশে

প্রকাশিত: ১১:৫৪ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৪, ২০২১

নমপেন থেকে দূরে রেললাইনের পাশে

অনলাইন ডেস্ক ::
কথা বলতে বলতে মাথা ঝাঁকিয়ে অদৃশ্য কাকে যেন নালিশ জানান। হঠাৎ খেয়াল হয়, আমি তাঁর কোলে মাথা রেখে তাকিয়ে আছি খোলা আসমানের দিকে। উঠে বসতে গিয়ে ঝিক করে মাথা ঘুরে যায়। ঘাড়-গর্দান ও কপালে বোলতার চাকের মতো বিজবিজ করছে বেদনার মিশেল দেওয়া ভোঁতা সেনসেশন। আমাকে উঠে বসতে দেখে মহিলা মৃদু হাসেন। তিনি অস্পষ্ট স্বরে প্রবোধ দেওয়ার মতো করে বলেন, ‘সহমতহ’ বা ‘দুঃখিত’। তাঁর মুখে দাঁত তেমন নেই, তবে গালে মুরগির পায়ের মতো কাটাছেঁড়া বিচিত্র এক দাগ। তিনি আরো বার দুই ‘সহমতহ সহমতহ’ বলে বিড়বিড় করে কাটা ডাবের জলে গামছার প্রান্ত চুবিয়ে আমার মুখ মুছিয়ে দেন। তখনই বুঝতে পারি, আমি পড়ে আছি রেললাইনের পাশে গাছতলায়। আমাকে ঘিরে আছে বস্তির আধা ন্যাংটা সব ছেলেপিলে। প্লাস্টিকের ময়লা কাপে মহিলা এবার আমাকে একটু ডাবের পানি খেতে দেন।

স্রোতে ভাসা পানসিতে শুয়ে শুয়ে কোনো দূর গ্রামের নোনা ধরা শানবান্ধা ঘাটের রেখার মতোই স্মৃতি ফিরে আসতে শুরু করে। যার সঙ্গে নমপেন ছেড়ে সিহানুকভিলের কাছাকাছি একটি গ্রামে এসেছিলাম ভোরবেলা, তার নাম কিংবা ঠিক কোথায় তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তা মনে পড়ে না; তবে সাফারি স্যুট পরা এ লোক আমাকে টুকটুকে চড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল মেইন রাজসড়ক থেকে অনেক ভেতরে, গোলমরিচ গাছের ছায়ায় একটি মজা পুকুরের পারে। তার পাশে লাউয়ের মাচা ও সবজিক্ষেত। ঠিক ওখানেই তৈরি হচ্ছিল কার যেন ইট-সিমেন্টের কোঠাবাড়ি। মাটি খুঁড়ে দালানের ফাউন্ডেশনের জন্য নালা করা হয়েছে। আর খোঁড়াখুঁড়িতে বেরিয়ে এসেছে পুরাকালের কোনো মন্দিরের দেয়াল, সোপান ও বেদির ভগ্নাবশেষ। এ মন্দিরের ডিসকভারি নিয়ে কোথাও কিছু লেখা হয়নি। সাফারি পরা মানুষটি আমাকে বলেছিল, শুধু মন্দিরই না, খোঁড়াখুঁড়িতে পাওয়া গেছে বেশ কয়েকটি পিতলের কলসিও। কলসভর্তি ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের কোনো এক সুলতানের রুপার মোহর। এগুলো গ্রামেরই একজনের বাড়িতে আছে, শুধু ছবি তোলা নয়, ডলারে পেমেন্ট করতে পারলে কয়েকটি মুদ্রা কেনাও যাবে। একটি বাড়ির দাওয়ায় মাদুরে বসে পাকা পেঁপেও খেয়েছিলাম, তা মনে পড়ে। তার পর থেকে সব কিছু ঝাপসা ধূসর। পকেটগুলো খুঁজি, মানিব্যাগ, প্যানট্যাক্স ক্যামেরা, ওমেগা ঘড়ি সবই গেছে। হান্টিং ভেস্ট পরে বেরিয়েছিলাম, যার লাইনিংয়ের ভেতর সেলাই করা আছে কিছু ডলার, গায়ে তা-ও নেই।

kalerkanthoমহিলা বাতে পঙ্গুপ্রায়। লাঠি ভর দিয়ে হাঁটেন। তাঁর পেছন পেছন চলে আসি তাঁদের বস্তিতে। সঙ্গে কলবল করা বেশ কয়েকটি ছেলেপিলে। রেললাইনের দুই পাশে কাঠ ও জং ধরা টিনে তৈরি খুঁটির ওপর বেশ কয়েকটি ঘরদুয়ার। লাইনের পাশে দড়ি টানিয়ে শুকানো হচ্ছে কাপড়চোপড়, ন্যাতাকিনি, অন্তর্বাস। পাড়াটি বস্তি হলেও মানুষজনের পেশা কী—ঠিক বুঝতে পারি না। বয়স্ক মহিলা তাঁর ঘরের সিঁড়িতে বসে পড়েন। আন্দাজ করি, এখান থেকে নমপেন ফিরে যেতে টুকটুক কিংবা ট্যাক্সিতে তিন-চার ঘণ্টা সময় লাগবে! কিন্তু টাকা-পয়সা তো খোয়া গেছে, ট্যাক্সিওয়ালাকে দেব কী? আর মেইন রাজপথই বা কোথায়? বৃদ্ধা বোধ করি আমার মনের কথা বুঝতে পেরে রেললাইন দেখান। আশপাশে কোনো ইস্টিশন আছে কি? বৃদ্ধা ডাবের জলে সিক্ত গামছায় আবার আমার মুখ মুছিয়ে দিয়ে বিদায় জানান। তারপর আমি বস্তির কয়েকটি ছেলেমেয়ের সঙ্গে রেললাইন ধরে সিধা হাঁটতে শুরু করি।

এদিকে মনে হয় কোনো ইস্টিশন নেই। আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটি লেভেলক্রসিংয়ে আসি। পাশে খুঁটির ওপর দাঁড় করানো শণ-বাঁশ-বেতের ছোট্ট কুঁড়েঘরে লেভেলক্রসিংওয়ালার সস্ত্রীক বসবাস। মানুষটি বোধকরি মাইনে পা দিয়েছিল, পরে তার দুই পা কাটা যায়। প্রৌঢ় এই লোক কুটিরের উঠানে তালগাছের ছায়ায় দড়ির হ্যামকে বসে মহিষের শিঙে তৈরি মস্ত এক চিরুনির দাঁত দিয়ে ক্রাচে ঘষে ঘষে শব্দ করছে। আমি ‘সুকসাবাই’ বা ‘শুভেচ্ছা’ ইত্যাদি কিছু শব্দ ও দু-চারটি বাক্য ভিন্ন খেমার ভাষায় তেমন কিছু বলতে পারি না, তাই হাতের ইশারায় রেললাইন দেখিয়ে নমপেন যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করি। মানুষটি কপাল কুঁচকে প্রথমে প্রবলেমটি বোঝার চেষ্টা করে, তারপর চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আমাকে আশ্বস্ত করে হ্যামকে বসতে বলে।

আমি একটু টেনশন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। ঠিক তখনই কুটিরের পাটাতনের নিচের খোলামেলা জায়গা থেকে প্লাস্টিকের টুল হাতে এগিয়ে আসে একটি মেয়ে। আমি টুলে বসে তার দিকে তাকাই। প্যাদাড়ে ফুটে ওঠা ফুলের মতোই তার চোখেমুখে খেলা করে বন্য সৌন্দর্য। সে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে যেন মনে মনে কিসের মাপজোখ করে। তারপর সে ফিরে যায় কুটিরে। ওপরের পাটাতনে সারি দিয়ে রাখা বেশ কিছু ঠিল্লা, তা থেকে ঢেলে মাটির ভাঁড়ে করে সে আমাদের জন্য কিছু নিয়ে আসে। আমি পানীয়তে চুমুক দিই, অনেকটা তাড়ির মতো, তবে তা থেকে কিসের যেন সৌরভ ছড়ায়। আমি পকেট উল্টে ইশারায় তা খালি জানালে সে হেসে ওঠে খিলখিল করে। তার ঊর্ধ্বাঙ্গ দুললে—হঠাৎ করে বেজে ওঠা গানের সুরতাললয়ের মতোই অত্যন্ত কাঁচা বয়সের এ মেয়ের শরীরের নড়াচড়ায় যেন চারদিকে ছড়ায় ঝংকার।

বিকেল পড়ে গিয়ে দূরের তালকুঞ্জে নেমে এসেছে সূর্যাস্ত, দিগন্ত ফুঁড়ে ঝিকঝিক করে ধেয়ে আসে তিন বগির একটি মালগাড়ি। লেভেলক্রসিংওয়ালা হাততালি দিলে মেয়েটি নেমে আসে কুটির থেকে। সে বাঁকা হয়ে লিভার টেনে কাঠের দণ্ড ফেলে দিয়ে দুই পাশে রোড ব্লক করে নিতম্ব দুলিয়ে চলে আসে হ্যামকের কাছে। লেভেলক্রসিংওয়ালার কাছ থেকে লাল নিশান নিয়ে সে আবার ছুটে যায় রেললাইনের কাছে।

মালগাড়িটি থামে। ছোট্ট ইঞ্জিনের মারকুটে ড্রাইভার নেমে এসে আমার পাশে আরেকটি টুলে বসে ভাঁড়ে তাড়ি খায়। সে নিয়ে এসেছে আফিমের গুলি। লেভেলক্রসিংওয়ালা তা নিয়ে পাইপ ধরালে, ড্রাইভার মেয়েটিকে ড্রাইফিশ, পাউরুটি আর জেসমিন রাইসের দুটি প্যাকেট দেয়। আফিমের মৌতাত খানিক জমে আসতেই সে খিলখিলানো মেয়েটির দেহসংলগ্ন হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায় কুটিরের ওপরতলার পাটাতনে। লেভেলক্রসিংওয়ালা একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে চেয়ে থাকে দূরের তালকুঞ্জের দিকে।

ইঞ্জিনে চড়ে বেশ রাতে আমি ফিরি নমপেনে। বেশ কয়েক মাস পর আমি বিশ্বস্ত ইন্টারপ্রেটারসহ একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার রেডিও লাগানো নিরাপদ ল্যান্ডক্রুজার নিয়ে আবার ফিরে আসি এই এলাকায়। ভগ্ন মন্দিরের কয়েকটি ছবি তোলার জন্য যে গ্রামে আমার ঘড়ি, মানিব্যাগ ও ক্যামেরা ছিনতাই হয়েছিল সেখানে যেতে চাই। যেহেতু গ্রামের নাম আমার মনে নেই, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মাটির নিচে শত শত বছর ধরে লুকিয়ে থাকা মন্দিরের কোনো শুলুক-সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে এদিক-ওদিক খানিক ঘোরাঘুরি করে রেললাইনের পাশে বস্তিটি খুঁজে পাই।

বৃদ্ধা মহিলার জন্য আমি কিছু খাবারদাবার নিয়ে এসেছি। তাঁর বাড়ির সিঁড়িতে আমরা বসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। অবশেষে একে-তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ইন্টারপ্রেটার আমাকে জানায়, দিন পনেরো আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তারপর আমরা হেঁটে যাই লেভেলক্রসিংয়ে। মাইনে পা হারানো প্রৌঢ় হ্যামকেই শুয়ে ছিলেন। এক প্যাকেট সিগ্রেট তাঁকে দিলে তিনি তা খুলে একটি শলায় আগুন ধরান। আমি কুটিরের দিকে বারবার তাকাচ্ছি দেখে অতঃপর ম্লান হেসে তিনি আমার ইন্টারপ্রেটারকে বলেন, তাঁর স্ত্রী মালগাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে চলে গেছে নমপেনে।

ইঞ্জিনের ড্রাইভারের তালাশে আমি বার কয়েক নমপেন রেলওয়ে ইস্টিশনেও যাই। একটি মালগাড়িকে শনাক্তও করি। কিন্তু এ ইঞ্জিনের এখন ভিন্ন ড্রাইভার। ইন্টারপ্রেটার আমি যে ড্রাইভারকে খোঁজ করছি তার নাম সংগ্রহ করে, আরো তথ্য পাওয়া যায় যে সে নাকি আজকাল রেলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে একটি যুবতি মেয়েকে নিয়ে রেডলাইট পল্লীতে বাস করছে।

হাতে একটু অবসর আসতেই রবিবারের সন্ধ্যাবেলা আমি নমপেন শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের তলকক বলে অপেক্ষাকৃত সস্তা রেডলাইট পল্লীতে আসি। ছোট ছোট ছাপরা ঘরের কার্নিসে কার্নিসে শুধু লাল নিয়নের রহস্যময় বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। মালগাড়ির ড্রাইভারের নাম আমার মনে আছে, কিন্তু কিভাবে তার তালাশ করব? আর তাকে পেলে করণীয় কী—ঠিক বুঝতে না পেরে সড়কে দাঁড়িয়ে থাকুমুকু করি। হুইলচেয়ার ঠেলে ঠেলে সুরতালে শিস দিয়ে এক লোক আমার পাশে থেমে যেন ছন্দ মিলিয়ে বলে ওঠে, ‘সোম সোয়াকম’ বা ‘ওয়েলকাম’। মানুষটির গণ্ডদেশ, কপাল ও গলায় থিকথিকে কয়েকটি ক্ষতচিহ্ন। তাতে চুন, হলুদ বা অন্য কিছুর প্রলেপ দেওয়ায় লোহিত নিয়নের আলোয় তা ঝলমল করে।

তার হুইলচেয়ার থেকে ঝুলছে কেয়ার শুকনা পাতা দিয়ে তৈরি ছোট্ট ছোট্ট বাক্স। আমি তাকে রেল ড্রাইভারের নাম জিজ্ঞেস করি। সে বিষয়টি আমলে না এনে একটি বাক্স খুলে দেখায়। তাতে কলাপাতায় মোড়ানো চালের গুঁড়ার পিঠা ও পলিথিনের প্যাকেটে কিছু তাজা ফুল। কয়েকটি ডুমো মাছি নিয়নের আলো মেখে খোলা বাক্সে ঢুকে পড়ে। আন্দাজ করি, লাল আলো জ্বালা ঘরে ঢুকে সস্তা প্রসাধনে চোখমুখ চর্চিতা অপেক্ষমাণ নারীকে এ ধরনের একটি বাক্স উপহার দেওয়া এ পল্লীর রীতি। আমি বাক্সটি ক্রয়ে গড়িমসি করলে সে অধৈর্য হয়ে বলে, ‘তানে উক ইয়ো ইল কেনিয়োমতে?’ এ বাক্যটিও আমি খেমার ভাষায় বাতচিতের সময় অনেকবার শুনেছি, যার সরল অর্থ হচ্ছে—‘আমি যা বলছি আপনি কি তা বুঝতে পারছেন না?’ আমি জবাবে ‘আরকুন’ বা ‘থ্যাংকিউ’ বলি।

লাল আলোর মোহ ছড়ানো পল্লীতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ বাবদে আর খোঁজখবর করা বেদরকারি মনে হয়।

সংবাদ অনুসন্ধান ক্যালেন্ডার

MonTueWedThuFriSatSun
22232425262728
2930     
       
  12345
2728     
       
28      
       
       
       
1234567
2930     
       

আমাদের ফেইসবুক পেইজ