যেভাবে করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট দিতো সাহাবউদ্দিন মেডিকেল

প্রকাশিত: ১১:২৮ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৯, ২০২০

যেভাবে করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট দিতো সাহাবউদ্দিন মেডিকেল

অনলাইন ডেস্ক :;

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়াই র‌্যাপিড কিট দিয়ে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে আসছিল রাজধানীর গুলশান-২ এ অবস্থিত সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এছাড়া তারা অ্যান্টিবডি পরীক্ষার নামে রোগীদের কাছ থেকে তিন হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা করেও নিত বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগে রোববার (১৯ জুলাই) বেলা তিনটায় র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের নেতৃত্বে হাসপাতালটিতে অভিযান শুরু করে র‌্যাব-১। তাদের সঙ্গে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিদর্শক নাহিন আল আলম অংশ নেন।

রোগীদের টেস্ট না করেই ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে বলে অভিযোগ পেয়েছে র‌্যাব। হাসপাতাল থেকে ভুয়া ও জাল রিপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে। এসব রিপোর্ট প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি সরকারি কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল ও কম্পিউটারে স্ক্যান করে বসিয়ে নিতো বলেও জানিয়েছে র‌্যাব। হাসপাতালটির অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) মেয়াদোত্তীর্ণ সার্জিক্যাল সামগ্রী উদ্ধার করা হয়। নেগেটিভ রোগীকে করোনা পজিটিভ বলে হাসপাতালে ভর্তি রেখে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের অসঙ্গতি পেয়েছে র‌্যাব। অভিযানে অসহযোগিতা করায় সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আবুল হাসনাতের সঙ্গে হাসপাতালের ইনভেন্টরি অফিসার শাহজির কবির সাদিকেও হেফাজতে নিয়েছে র‌্যাব।

 

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিদর্শক নাহিন আল আলম সাংবাদিকদের জানান, তাদের কাছে অভিযোগ এসেছে, এই হাসপাতালে করোনার অ্যান্টিবডি টেস্ট করা হচ্ছে। অভিযানে তারা প্রমাণ পেয়েছেন। এ ধরনের পরীক্ষার জন্য কোন অনুমোদন তাদের ছিল না।

র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জানান, হাসপাতালটিতে আমরা তিনটি অভিযোগ পেয়েছি। এর মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে কোভিড-১৯ পরীক্ষার অনুমোদন দিয়েছিল। কিন্তু তাদের কোভিড-১৯ পরীক্ষার স্বয়ংক্রিয় মেশিন না থাকায় অনুমোদন বাতিল করা হয়। এর পরও তারা কোভিড-১৯ পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছিল। তারা বাইরের রোগীদেরও টেস্ট করেছে। এ টেস্টগুলো অননুমোদিত ডিভাইসের মাধ্যমে করেছে। যে রিপোর্ট দিয়েছে তা সবই ভুয়া। দ্বিতীয়ত, অভিযোগ হলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিছু পরীক্ষা বাইরের হাসপাতাল থেকে করে তা নিজেদের হাসপাতালের প্যাডে লিখে রোগীদের দিয়েছে। তৃতীয়ত, তারা কিছু পণ্য যেমন মাস্ক, গ্লাভস- এগুলো একাধিকবার ব্যবহার করছে। এগুলো মূলত একবারই ব্যবহারযোগ্য। কিন্তু তারা এগুলো বার বার ব্যবহার করছে।

তিনি জানান, মূলত হাসপাতালটিতে র‌্যাপিড কিট দিয়ে করোনা টেস্ট করানো হয়-এমন অভিযোগ পেয়ে আমরা অভিযানে এসেছিলাম। কিন্তু হাসপাতালে এসে দেখি তাদের ওখানে কোন র‌্যাপিড কিট নেই। এমনকি পরীক্ষার কোন সরঞ্জামও দেখতে পাইনি। তবে তাদের ওখানে কিছু করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট পেয়েছি, যেগুলো ভুয়া। এছাড়া তারা অ্যান্টিবডি ও এন্টিজেন পরীক্ষার নামে রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করত অভিযোগ পেয়েছি। অভিযানে আমরা তাদের হাসপাতালে যেসব রিপোর্ট পেয়েছি সেখানে দেখা গেছে, তারা টঙ্গী ২৭ ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতাল থেকে করোনার পরীক্ষা করিয়েছেন। প্রশ্ন হলো পরীক্ষা করতে ঢাকায় এতগুলো হাসপাতাল থাকতেও তারা কেন টঙ্গী যাবে? এছাড়া করোনার পরীক্ষা তারা আরও কয়েকটি হাসপাতাল থেকে করিয়েছে বলে আমরা অভিযানে এসে দেখতে পেয়েছি। আবার অন্য স্থান থেকে পরীক্ষা করে নিয়ে এসে তারা নিজেদের নামে চালিয়েছে। এসব আমরা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি।

সারওয়ার আলম বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে তাদের কোভিড-১৯ পরীক্ষার অনুমোদন দিয়েছিল। তবে তাদের কোভিড-১৯ পরীক্ষার স্বয়ংক্রিয় মেশিন না থাকায় অনুমোদন বাতিল করা হয়। এরপরও তারা কোভিড-১৯ পরীক্ষার চালিয়ে যাচ্ছিল।হাসপাতালটিতে আমরা কোন আরটিপিসিআর মেশিন পাইনি। তবে তারা দাবি করেছে করোনাভাইরাস শনাক্তে তারা নিজেদের আিইরটিপিসিআর মেশিনে টেস্ট করেছে। তারা হাসপাতালের বাইরের রোগীদেরও টেস্ট করেছে। এ টেস্টগুলো অননুমোদিত ডিভাইসের মাধ্যমে করেছে। যে রিপোর্ট দিয়েছে তা সবই ভুয়া।

তিনি আরও জানান, হাসপাতালটির একটি অপারেশন থিয়েটারে অভিযান চালানো হয়। এ সময় ওপারেশন থিয়েটারটিতে মেয়াদোত্তীর্ণ পাঁচটি সার্জিক্যাল সামগ্রী (এনডোট্রাসিয়াল টিউব) উদ্ধার করা হয়। পরে এসব সার্জিক্যাল সামগ্রী যাচাই করে দেখা যায়, এগুলোর কোনটির মেয়াদ ২০০৯ সালে আবার কোনটির মেয়াদ ২০১১ সালে শেষ হয়েছে। হাসপাতালটির বাকি চারটি অপারেশন থিয়েটার তালা মারা। এসব সার্জিক্যাল সামগ্রী অপারেশন করার সময় রোগীদের অজ্ঞান করার কাজে ব্যবহৃত হতো। বিভিন্ন ধরণের অনিয়ম ও অসঙ্গতি পেয়েছি শাহাবুদ্দিন হাসপাতালে। এজন্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

অভিযানে উপস্থিত ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, এসব টিউব সাধারণত অপারেশনে এনেস্থিশিয়া দেয়ার সময় রোগীর শ্বাসনালীতে ঢোকানো হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ সার্জিক্যাল টিউব ব্যবহারে রোগীর ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এতে অনেক সময় রোগীর মৃত্যুঝুঁকি’ রয়েছে। কোভিড-১৯ (করোনাভাইরাস) রোগীদের চিকিৎসায় যুক্ত বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মধ্যে অন্যতম ৫০০ শয্যার সাহাবদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সম্প্রতি বেশকিছু অনিয়মের অভিযোগ ওঠে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে।

সাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. মনসুর আলী অনুমতি স্থগিতের বিষয়টি স্বীকার করে জানায়, নিজেদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অ্যান্টিবডি নির্ণয়ের জন্য বিদেশ থেকে শ’খানেক কিট আনা হয়। কিন্তু এখনো পরীক্ষা করা হয়েছে কিনা, তা তিনি জানেন না। যদি পরীক্ষা করা হতো, তাহলে তার জানার কথা।

প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাস পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতির অপরাধে এর আগে রাজধানীর রিজেন্ট হাসপাতাল, জেকেজি পাবলিক হেলথসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় র‌্যাব। সারাদেশে এই জালিয়াতির ঘটনায় রোববার পর্যন্ত রাজধানী দেশের বিভিন্ন থানায় ১৩টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে ৬১ জন।