বিশ্ব অর্থনীতিতে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে

প্রকাশিত: ১১:৩৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৬, ২০২২

বিশ্ব অর্থনীতিতে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে

আবু আহমেদ:: গত দুই বছর কভিডের কারণে বিশ্বজুড়ে পণ্য উৎপাদন অনেকটা বন্ধ ছিল, ভোগব্যয় কমে গিয়েছিল, পর্যটন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যাহত হয়েছিল। অর্থনীতি বিধি-নিষেধ মুক্ত হওয়ায় এখন সরবরাহ চেইনে বড় আকারের প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বিভিন্ন দেশ উদার মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরে যে সুদের হার কম ছিল, সেটা এখন নেই। দেশটি জোরেশোরে ডলার প্রিন্ট করে বাজারে ছাড়ছে। ইউরোপেও একই অবস্থা। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে আমাদের মূল্যস্ফীতি এখন গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ভারতেও তাই। kalerkanthoমূল্যস্ফীতি ৭-৮ শতাংশে পৌঁছে গেছে। দেশটিতে ডলারের দাম ৭২ থেকে ৭৬ রুপিতে পৌঁছে গেছে। সামনের দিনগুলোতে ভারতীয় রুপি আরো মূল্য হারাতে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। তুর্কি লিরা যা-তা অবস্থায় চলে গেছে। আমাদের এখানেও প্রতি ডলার প্রায় ৯০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এ রকম আরো অনেক বিষয় রয়েছে, যেগুলো বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের লক্ষণ হিসেবে দেখা দিতে শুরু করেছে।

বিভিন্ন দেশে মানুষ যেভাবে ঋণে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে তা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। ব্যক্তিগত ব্যাংকঋণ, সরকারি ঋণ ও প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ (ইনস্টিটিউশনাল লোন)—সব মিলিয়ে মানুষ ঋণফাঁদে আটকা পড়েছে। এগুলো শোধ করার ক্ষমতা অনেকেরই নেই। শেষ পর্যন্ত দেশগুলোকে এসব ঋণ মওকুফ করে দিতে হবে, যার চাপ পড়বে অর্থনীতিতে। বৈশ্বিক অর্থনীতি আগের জায়গায় যাওয়া অনেকটা কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। এখন ওমিক্রন নামে কভিডের আরেকটা ধরন দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো দেশে আবারও লকডাউন দিচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চিত্র গ্লোবাল ইকোনমিক সিনারিও খুব অবস্থার দিকে যাচ্ছে।

আমাদের দেশে গত দুই বছর দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। এটা সহসাই কমার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। অন্যদের তুলনায় আমাদের অর্থনীতি ভালো করছে। আইএমএফ বলেছে, আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬.৬ শতাংশ হবে। সেটা খারাপ নয়; কিন্তু সেটার সঙ্গে মূল্যস্ফীতি হানা দিচ্ছে। গত বছর থেকেই এটা আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। এর ওপর বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতিটা আমাদের ওপর আসছে বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে। তেলের দাম সামনে আরো বাড়তে পারে। খাদ্যশস্যেরও দাম বাড়বে। এরই মধ্যে খবর পাওয়া গেছে, চীন গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ খাদ্য মজুদ করছে। এর অর্থ হচ্ছে যে গ্লোবাল মার্কেটে পণ্যের দাম বাড়বে। এখন আমরা যদি চাল আমদানি করি, আমাদের বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে।

অন্যদিকে আবারও কোল্ডওয়ার বা শীতলযুদ্ধের মতো একটি পরিস্থিতিতে বিশ্ব ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে। চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সামনে এটা বাড়তে পারে। ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনা রয়েছে। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক আরো নিচের দিকে গেছে। ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো খুব দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে। ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা আরেকটি সমস্যা। সম্প্রতি চীনকে মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া মিলে নতুন প্রশান্ত মহাসাগরীয় সামরিক জোট—অকাস গড়ে তুলেছে। একই উদ্দেশ্যে জাপানের সামরিক তৎপরতা বাড়ছে এবং ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে আরেকটি জোট—কোয়াড গঠন করেছে। এর বিপরীতে বড় আকারে চীন-রাশিয়ার যৌথ সামরিক মহড়া দেখা গেছে। এ ছাড়া তাইওয়ান নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা চলছে। গত ৫০ বছরে, বিশেষ করে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর আমরা কখনো এত বেশি এলাকায় এত বেশি যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব দেখিনি। স্নায়ুযুদ্ধোত্তর সময়ে গত ৩০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র ছোট ছোট কয়েকটি দেশে আক্রমণ করলেও সেটাকে বৈশ্বিকভাবে ততটা নাড়া দেয়নি। কিন্তু এখন যুদ্ধের চেয়েও এই যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব এবং বিশ্বনেতাদের রক্ষণশীল মনোভাব স্নায়ুযুদ্ধের বার্তা দিচ্ছে, যা বিশ্ব অর্থনীতিকে নাড়া দিতে পারে চরমভাবে।

অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন অনেক বেশি আন্তঃসংযুক্ত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বেশির ভাগ অর্থনীতিই নির্ভর করত অভ্যন্তরীণ চাহিদার ওপর। এখন অর্থনীতি নির্ভর করছে বৈশ্বিক চাহিদার ওপর। যেমন আমাদের ক্ষেত্রে। আমরা যখন স্বাধীনতা পাই, আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ একেবারেই সামান্য ছিল। এখন আমাদের জিডিপির বেশ বড় একটা অংশ বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। ফলে এখন যদি বড় সামরিক শক্তিগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়, কেউ আক্রান্ত হয়, বিশ্ব অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে আসে, তথা উৎপাদন কমে গিয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়, তখন সেটা আমাদেরও আঘাত করবে। সবাইকেই আঘাত করবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের জন্য আরেকটা দুশ্চিন্তা যোগ হয়েছে। সেটা হলো মানবাধিকার ইস্যুতে কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া। এটা অনেককেই ভাবিয়ে তুলছে। এর অন্যতম প্রভাব হতে পারে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়া। তবে আশা করছি, এটা সাময়িক হবে এবং দুই দেশের সম্পর্ক আরো বাড়বে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বে যে অস্থিরতা চলছে সেটা নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশকেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দারিদ্র্য বৃদ্ধি এবং সামাজিক অস্থিরতার জন্য তৈরি থাকতে হবে। কারণ এটা আমাদের একার সমস্যা নয়। এটা বৈশ্বিক হতে যাচ্ছে।

এখন অনেকে বলছেন, সামনে ডলারের দাম কমে যাবে স্বর্ণের বিপরীতে। মানে, স্বর্ণের ডিমান্ড বেড়ে যাচ্ছে। লোকজন কাগজের মুদ্রা বা নগদ টাকায় আস্থা রাখতে চাচ্ছে না। বৈশ্বিকভাবেই মুদ্রাবাজারে ধস নামবে এবং তাতে মার্কিন ডলারও রয়েছে। এখন দ্বিপক্ষীয়ভাবে কোনো দেশের সঙ্গে মার্কিন ডলার বেশি শক্তিশালী। যেমন—ভারতের রুপির বিরুদ্ধে মার্কিন ডলার শক্তিশালী। ভারতে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) কোটি কোটি ডলার উত্তোলন করা হয়েছে। ভারত থেকে এই বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রত্যাহার হওয়ায় দেশটিতে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। তবে বৈশ্বিক বাজারে দরপতনের আশঙ্কা থেকে ডলার মুক্ত নয়।

বাংলাদেশে এফডিআই খুব বেশি নেই, যা প্রত্যাহার হলে ডলারের দাম বেড়ে যাবে। তবে কোনো কারণে যদি সামনের দিনগুলোতে আমদানি বেড়ে যায় এবং রপ্তানি কমে যায় অর্থাৎ বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা যদি বেশি হয়, তাহলে সেটা আমাদের অর্থনীতির জন্য সুখকর হবে না। কারণ লম্বা সময় আমরা এটা টেনে নিতে পারব না। শ্রীলঙ্কায় দেখা গেছে, তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কয়েক বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে এবং শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনীতি বাস্তবিক সমস্যায় পড়ে গেছে। খাদ্য আমদানি, তেল আমদানি করার জন্য তাদের পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা নেই। এভাবে ছোট ছোট অনেক অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। এমনকি পাকিস্তানও খুব কঠিন সময় পার করছে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার দিক দিয়ে। বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যথেষ্ট ভালো। ফলে সংকটটা অনুভব করছে না। তাই বাংলাদেশকে দীর্ঘ মেয়াদে চিন্তা করতে হবে আমাদের যদি উন্নয়ন প্রকল্পগুলো চালিয়ে যেতে হয় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ৬.৫ থেকে ৭ শতাংশে নিয়ে যেতে হয়, তাহলে আমাদের খরচের ক্ষেত্রে হিসাব-নিকাশ করে চলতে হবে।

মানুষ এই বৈশ্বিক সংকটে অ্যাসেট হোল্ডিং তথা সম্পদ ধারণের ধরন পরিবর্তন করছে। এমনকি ম্যাচিউরড মার্কেটও ইকুইটি ছেড়ে স্বর্ণের দিকে যাচ্ছে। ফলে স্বর্ণের চাহিদা বাড়ছে এবং দামও বাড়ছে। বড় অর্থনীতি চীনও স্বর্ণ মজুদ করছে। অর্থনীতি যখন ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যায় তখন এসব ঘটে। চীনের খাদ্য মজুদের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশেরও চিন্তা করা উচিত, আমরা ছয় মাস বা এক বছরের জন্য খাদ্যশস্য রিজার্ভ রাখব কি না। এটা করা উচিত। কারণ এটাও এক ধরনের বিনিয়োগ। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ধরে রাখা নির্ভর করছে পণ্য রপ্তানি ও বিদেশে কর্মী পাঠানোর প্রবৃদ্ধিটা কতটা ধরে রাখা যায় তার ওপর। এ দুটিই এখন পর্যন্ত আমাদের পক্ষে আছে। মনোযোগ রাখতে হবে এটা যেন ধরে রাখা যায়।

তবে একটা জায়গায় বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে এবং বাংলাদেশ সেদিকে মনোযোগও দেয়নি খুব একটা। সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ কোনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জোটে যুক্ত হতে পারেনি। বৈদেশিক বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা এবং তা আরো বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা বড় ভূমিকা রাখে। এ ধরনের জোটের সহযোগী সদস্য বা পূর্ণ সদস্য হতে পারলে বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে। বাংলাদেশের মনোযোগ দেওয়া উচিত ভারত ও চীনের বাজারে মুক্ত প্রবেশের দিকে। তারা আমাদের এই সুযোগ দিতে চাইলেও অনেক প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। সেগুলো দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে। সার্ক দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরো জোরদার করা উচিত। মোটকথা আমাদের নতুন বাজার খুলতে হবে, একই সঙ্গে রপ্তানি পণ্যেও বৈচিত্র্য আনতে হবে। যেমন—কৃষিজাত পণ্যের যথেষ্ট ভালো সম্ভাবনা আছে। সেটার জন্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে, বিমানবন্দরে কৃষিপণ্য প্রিজারভেশনে মনোযোগ দিতে হবে।

মূল কথাটা হচ্ছে, বাংলাদেশ এত দিন ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক সিনারিও থেকে যে সুবিধাটা পেয়েছে, সেটা সামনের দিনগুলোতে ততটা সহজ না-ও হতে পারে। বৈশ্বিকভাবে যদি অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হয়, আমরাও এর বাইরে থাকতে পারব না। বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সিলনিউজবিডি ডট কম / এস:এম:শিবা

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ