ইউপি নির্বাচনে সংঘাত-সংঘর্ষ কেন

প্রকাশিত: ১১:৪৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৬, ২০২২

ইউপি নির্বাচনে সংঘাত-সংঘর্ষ কেন

অনলাইন ডেস্ক :: দেশে এখন ইউপি নির্বাচন চলছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী ৩১ জানুয়ারি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। সময়ের হিসাবে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনটি আট মাস ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যে কয়টি পর্ব এরই মধ্যে শেষ হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটি পর্বেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এবং তাঁদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘটিত তীব্র দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও হানাহানির দৃশ্য সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। অবশ্য অতীতেও স্থানীয় পর্যায়ের এই নির্বাচনটিতে প্রার্থী এবং সমর্থকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটেছে। এবার হয়তো সংখ্যাটি অতীতের চেয়ে বেশি।

kalerkanthoপরিস্থিতি দেখে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এবং সমর্থকদের মধ্যে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রবল বা তীব্রতর হয়েছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টিকে গণতান্ত্রিক চেতনায় দেখা, বোঝা এবং মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি এই পর্যায়ের প্রার্থী ও সমর্থকদের মধ্যে খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। ছলে-বলে-কৌশলে প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিপক্ষকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়া কিংবা নিজের জয়কে যেকোনো উপায়ে নিশ্চিত করার আকাঙ্ক্ষা অনেকের মধ্যেই প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। সে কারণেই নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় প্রতিপক্ষের ওপর হামলা করার মতো বেআইনি কাজ করতেও তাঁরা দ্বিধা করেননি। কোথাও কোথাও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।

এই মানুষেরা একে অন্যের খুবই পরিচিত। আত্মীয়-স্বজন, এমনকি রাজনৈতিকভাবেও এক দলেরই তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী। কিন্তু নির্বাচনে জয়লাভ করার মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে তাঁরাই একে অন্যের বিরুদ্ধে এমন আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছেন, যা মানবিক মূল্যবোধ ও সহানুভূতির সব মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। সুতরাং স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে অতীত থেকে চলে আসা দলাদলি-দ্বন্দ্ব, সংঘাত-সংঘর্ষ, হানাহানি, রক্তারক্তি যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির অন্তর্নিহিত দুর্বলতারই বৈশিষ্ট্যজাত কি না—তা নিয়ে গভীর পর্যালোচনা জরুরি হয়ে পড়েছে।

এবারের ইউপি নির্বাচনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আমাদের জানা আছে; এক. চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ থাকলেও অন্য পদগুলোতে তা নেই। দুই. বড় একটি রাজনৈতিক দল বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করেছে। তাদের মূল অভিযোগ নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে। দলীয়ভাবে বর্জনের সিদ্ধান্ত নিলেও চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য পদে বিএনপির অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পছন্দের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন। নির্বাচনে কোথাও কোথাও বিএনপি ঘরানার প্রার্থীরা নির্বাচিতও হচ্ছেন। তিন. দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পছন্দের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন। দলের মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীদের অনেকেই দলের বিদ্রোহী কিংবা বিরোধী দল কিংবা অন্য স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হয়েছেন। চার. আওয়ামী লীগের মনোনীত এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও সংঘর্ষের ঘটনায় তৃণমূলে সক্রিয় ক্ষমতাবলয় ও পেশিশক্তির প্রচ্ছন্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। হানাহানির মতো ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় শুধু দলেই নয়, সমাজেও দীর্ঘ মেয়াদে বিভেদ দেখা দিচ্ছে। পাঁচ. দলীয় মনোনয়ন, নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা এবং নির্বাচনে দলীয় মন্ত্রী-এমপি, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে গ্রুপিং, নিজস্ব ক্ষমতাবলয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যক্তিগত পছন্দের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিতে পেশিশক্তির ব্যবহার এবং আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগও উঠেছে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক মহল ইউপি নির্বাচনকে স্বাধীনভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে দলীয় নেতাকর্মীদের নীতি ও কৌশল গ্রহণে তেমন কোনো দূরদর্শিতা দেখাতে পারেনি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ইউপি নির্বাচন বর্জন করার পর আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহল নির্বাচন কমিশনকে শক্ত হাতে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে আরো বেশি দৃশ্যমান অবস্থান গ্রহণ করলে নির্বাচনের পরিবেশ আরো অনুকূল হতো। তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ডালপালা মেলার সুযোগ পেত না। আওয়ামী লীগের জন্য সেটি হতো অনেক বেশি রাজনৈতিকভাবে জনসমর্থিত।

নির্বাচনে অংশগ্রহণ, প্রার্থী হওয়া, না হওয়া, মনোনয়ন পাওয়া, না পাওয়া, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য প্রতিপক্ষের ওপর দলবল নিয়ে হামলার যেসব খবর গণমাধ্যমে এসেছে তার বেশ কিছু সমাজতাত্ত্বিক-অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চরিত্রগত দিক ভেবে দেখা অপরিহার্য বলে মনে করছি। কেউ কেউ প্রায়ই বলে থাকেন, ৬০ থেকে ৭০ বছর আগে ইউপি নির্বাচনে এলাকার সম্মানিত ব্যক্তিরাই জনগণের আগ্রহে অংশগ্রহণ করতেন। নির্বাচনে তেমন বড় ধরনের কোনো হানাহানি ঘটত না বলেও অনেকেই দাবি করেন। তবে সেই সময় নির্বাচনের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ সাধারণ ভোটারদের মধ্যে, বিশেষত নারী ভোটারদের মধ্যে ছিল না। নারী ভোটারের উপস্থিতি তখন চোখে পড়ত না। এমনকি সাধারণ দিনমজুররাও ভোটদানে ততটা আগ্রহী হতেন না। সেই কারণে ভোটারের উপস্থিতির হার এখনকার চেয়ে অনেক কম ছিল। এর প্রধান কারণ ছিল, ওই সময় ইউনিয়ন কাউন্সিলের গ্রামীণ রাস্তাঘাট-স্কুল-কালভার্ট মেরামত বা দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির মতো কর্মকাণ্ডও খুব বেশি চোখে পড়ত না। চেয়ারম্যান-মেম্বারদেরও রাষ্ট্র বা সরকার থেকে বরাদ্দপ্রাপ্তি খুব একটা উল্লেখযোগ্য ছিল না। মৌলিক এই কারণে তখন ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের জনকল্যাণকর কর্মকাণ্ড মানুষের নজরে বেশি পড়ত না। সমাজের কিছু বিচার-আচার, চৌকিদার ও দফাদারি ট্যাক্স আদায়, টিউবওয়েল স্থাপন এবং দুর্যোগে কিছু রিলিফ প্রদান ছাড়া অন্য কোনো উন্নয়ন কার্যক্রমে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের তখন খুব একটা যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকত না।

কিন্তু গত তিন-চার দশকে দেশে অর্থনীতির যে পরিবর্তন ঘটেছে তার প্রভাব গ্রামগঞ্জেও পড়েছে। রাজনীতিতেও এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান। সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থেই ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত ক্ষমতা বিস্তৃত করেছে। এখন কাবিখা, কাবিটা, স্কুল-কলেজ-মাদরাসা-ধর্মীয় উপাসনালয় সংস্কার, রাস্তাঘাট ও পুল-কালভার্ট নির্মাণ, মেরামত, খাল খনন, পুকুর-দিঘি খনন ও সংস্কার, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, স্বামী পরিত্যক্তাদের ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, ট্রেড লাইসেন্স, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ নিবন্ধন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সেবা, দুস্থ ভাতা ইত্যাদি খাতে সরকারের নানা ধরনের বরাদ্দ ইউনিয়ন পরিষদকে আগের তুলনায় অনেক বেশি কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ করে দিয়েছে—যা মূলত নির্ভর করে কল্যাণবাদী অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতিতে বিশ্বাসী দল ও গোষ্ঠীর ওপর।

কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে গত কয়েক দশকে যেসব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক শক্তির উত্থান ঘটেছে, তাদের বড় অংশই লুম্পেন চরিত্রের তথা লুটপাট, দুর্নীতি ও ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক। গ্রামে যেসব ব্যক্তি সমাজ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্তৃত্ব ও প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পাচ্ছে, তাদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসার ততটা ঘটেনি, যতটা অর্থবিত্তের বৈভবে ক্ষমতাশালী হওয়ার সুযোগ ঘটেছে। এর ফলে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি গ্রামেও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। তারাই ক্ষমতার সব প্রতিষ্ঠানে কর্তৃত্ব করার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। ইউনিয়ন কাউন্সিল তাদের জন্য সবচেয়ে লোভনীয় ও আকর্ষণীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা তাদের ক্ষমতার উচ্চ স্তরে ওঠার বৈধতা প্রদান করে। এ কারণেই উঠতি গোষ্ঠী স্থানীয় ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতায় আসার সম্ভাব্য রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন পদ-পদবি বাগিয়ে নেওয়ার দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে।

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি তৃণমূল পর্যায়ে নিজেদের অর্থবিত্ত ও ক্ষমতার বলয় এসব গোষ্ঠীর মাধ্যমেই সৃষ্টি করে চলছে। এখানে আদর্শের বালাই খুব একটা নেই। দলও সাংগঠনিক কিংবা রাজনৈতিক চর্চায় খুব একটা মনোনিবেশ করতে পারছে না। দলের পদ-পদবি যেসব ব্যক্তির হাতে চলে গেছে, তারা যেকোনো নির্বাচনে অর্থবিত্ত এবং পেশিশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে কুণ্ঠা বোধ করে না। আওয়ামী লীগে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সময়ে দলীয় আদর্শের ধারক-বাহকদের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থে দলকে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

যে কারণে সাম্প্রতিক ইউপি নির্বাচনে দলের কোনো পর্যায়ের বাধা-নিষেধ অনেক ক্ষেত্রেই মূল্য পায়নি। আর নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া, বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া, হানাহানি-মারামারিতে লিপ্ত হওয়ার মতো ঘটনার মধ্যে সেটিরই প্রভাব লক্ষ করা গেছে। তারা ব্যক্তিগত ও কোটারি স্বার্থের নিরিখে পাওয়া, না পাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে, কিন্তু এর ফলে জনগণের কাছে যে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, সেটি তাদের কাছে কোনোই গুরুত্ব পায়নি। কারণ তাদের চরিত্রই তাদের ক্ষমতালিপ্সার ঊর্ধ্বে উঠে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার কোনো রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য যোগ্য করেনি। অন্যান্য নির্বাচনেও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের যে প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, তা একই গোষ্ঠীর উত্থানেরই ইঙ্গিত বহন করছে।

দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দিয়ে আওয়ামী লীগ গ্রাম পর্যায়ে দল এবং জনগণের মধ্যে বিভাজনের সরু খালকে কুমির চলাচলের নদীতে রূপান্তরিত করেছে কি না সেটাও এখন গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

সিলনিউজবিডি ডট কম / এস:এম:শিবা

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ