সিলেটে কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ ও শাবিপ্রবি ছাত্রীহল প্রতিষ্ঠা আন্দোলন

প্রকাশিত: ২:২৩ অপরাহ্ণ, জুলাই ২০, ২০২০

সিলেটে কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ ও শাবিপ্রবি ছাত্রীহল প্রতিষ্ঠা আন্দোলন

শাহরিয়ার বিপ্লব :: শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের নামকরণ নিয়ে সিলেটে আন্দোলন। খুব সম্ভবত ১৯৯৯সাল।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামসহ আরো দুইটি নাম নিয়ে বিএনপি-জামাত সহ কয়েকটি দল সিলেট জুড়ে ব্যাপক আন্দোলন। এক পর্যায়ে সহিংস।

একদিকে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মী ও অন্যদিকে নামকরণ বিরোধী বিশাল জোট।

আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়। সামনে ইলেকশন।

এই সময়ে বিরোধী দলের আন্দোলনে বৃহত্তর সিলেট জুড়েই অস্থিরতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মৃত্যুপরোয়ানা সহ নানাধরণের হুমকি ভয়ভীতি দেখাচ্ছে একটি গ্রুপ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং শিক্ষক সমাজের একটা বড় অংশ ভয়ের মধ্যে আছেন। প্রকাশ্যে অনেকে ক্যাম্পাসের বাইরে আসতে পারতেন না।

সেই রকম একটা অস্থির সময়ে হুমায়ুন আহমেদ ঘোষনা দিলেন নামকরণের পক্ষে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিরাপত্তার দাবীতে তিনি তাঁর পরিবারসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের মুল ফটকে সারাদিন ব্যাপী অনশন করবেন।

এই ঘোষনায় সিলেট শহর আরো অশান্ত হলো। বিরোধী দল ঘোষণা দিলো হুমায়ুন আহমেদকে সিলেটে আসতে দিবে না। কিন্তু হুমায়ুন আহমেদ অবিচল। মারা গেলেও তিনি আসবেন এবং পরিবার নিয়েই মারা যাবেন।

আওয়ামী লীগের তখনকার অনেক নেতাই চাইছিলেন হুমায়ুন আহমেদ না আসলে সিলেটের ঝামেলা এড়ানো যায়। অনেকে প্রস্তাবও দিয়েছিলেন আপনি ঢাকায় বসে অনশন করুন। আন্তর্জাতিক ভাবে হাইলাইট হবেন। তিনি বলেছিলেন আমি হাইলাইট হবার জন্যে যাচ্ছি না। সিলেটবাসির সাথে আমার একাত্মতা, আর তারা যে প্রতিবাদটি করার কথা সেটাই আমি করতে চাই।

পরে শুনলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন উনি যদি যেতে চান উনাকে যেন সবরকমের নিরাপত্তা দেয়া হয়।

সিলেট জেলার পুলিশ তখন খুব টেনশনে।

উনার জন্যে তিন লেয়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হলো। আউটার কর্ডন, ইনার প্রটেকশন এবং সাদা পোশাক।

ইনার প্রটেকশনে কেউ যেতে চাচ্ছে না। কারন বোমা বা গুলি করার হুমকি ছিলো। যারা নরমালি প্রটেকশনে থাকে তারা অনেকেই সিক করলো।

এসপি সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, অন্য কাউকে দিয়ে ভরসা পাচ্ছি না। প্রবলেম ইনভাইট করে নিয়ে আসবে। ক্রাইসিস ম্যানেজ করতে পারবে না। তুমি লোকাল ছেলে। ডিউটিটা তুমি করো।

আমি আগের রাতেই জালাল ভাইয়ে সাথে যোগাযোগ করলাম। জালাল ভাই বললেন আমি থাকবো রিসিভ করা থেকে বিদায় পর্যন্ত। তুমি থাকলে আমিও ভরসা পাবো। তোমাকে সবাই চিনে। বিরোধীদলের পরিচিতরা তোমার সাথে ঝামেলা করবে না। অমুক তমুকরে তোমার কথা কইমুনে।

আমি ভরসা পেলাম। বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করলাম। ক্রাইসিস ওভারকামের সব কৌশল এপ্লাই করি। সব কথা লেখার সময় এখনো আসে নাই।

যাই হোক। যথারিতি তিনি ট্রেনে করে এলেন। এসে হোটেল গুলশানে উঠলেন। নাস্তা করে হযরত শাহজালাল (রাঃ) র মাজার জিয়ারত করলেন।

তারপর গাড়ী বহর নিয়ে শাবি গেইটে।

সারাদেশে এই অনশন নিয়ে টেনশন উত্তেজনা অস্থিরতা হলেও হুমায়ুন স্যারকে দেখলাম শান্ত স্থির। হাসিখুশি। খুব বেশী জমায়েত ছিলো না প্রথম দিকে। শুধু প্রগতিশীল কিছু সাংস্কৃতিক কর্মী আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কর্মীরা ছাড়া।

ভয় আর আতংকের মধ্যেই সাংস্কৃতিক কর্মীরা প্রতিবাদী গান, কবিতা আর শ্লোগানে মুখরিত হর মূল ফটক। সাংবাদিক আর ফটোগ্রাফাররাই অনেক ছিলেন। বারোটার দিকে মানুষ বাড়তে থাকে।

স্যার বসে থাকতেন। মাঝে মাঝে কথা বলতেন। এক সময় দেখলাম মোবাইল ফোনটা জালাল ভাইয়ের হাতে দিলেন কল ধরার জন্যে। জালাল ভাই স্যারের ফোন ধরবেন না নিজের ফোন ধরবেন। নাকি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলবেন। পাগলের মতো ছোটাছুটি।

এদিকে আমারও একই অবস্থা। ওয়ারলেসে কান রাখা। বেজের সাথে যোগাযোগ রাখা। বিভিন্ন স্টেশনকে রিপ্লাই দেয়া। মোবাইল ফোনে একটু পরে পরে সিনিয়র অফিসারদের আপডেট দেয়া। ঢাকা থেকেও ফোন আসছে। তাদেরেকেও রিপোর্ট দেয়া।

এদিকে মদিনা মার্কেট আর টুকেরবাজারের দিক থেকে হঠাৎ হঠাৎ গুজব আসে। যদিও আমাদের কাউন্টার টিম ওই এলাকা দুটিকে সিল করে রেখেছে। তারপরেও সাবধানের মার নাই।

কখন যে বিকাল হয়ে যায় টেরই পাইনি। একটা টান টান উত্তেজনার মধ্যে স্যারের ডিউটি শেষ করতে পেরেছিলাম।

মুলত আমাদের এডভান্স কাউন্টার মেজার এবং কন্টাক্ট লিডারশীপ মেথড আমাদেরকে সফলতা দিয়েছিলো। সিলেট শহরের কোথাও একটা ককটেল বা বোমার শব্দ হয় নাই। একটা মিছিল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় মুখে আসে নি। অথচ মাত্র কিছুদিন আগেও জিন্দাবাজার এলাকায় প্রায় সারাদিন বিডিআর পুলিশের সাথে বিরোধীদলের সংঘর্ষ হয়েছিল। একজন না দুইজন মনে হয় মারাও গিয়েছিল।

এই ছবিটা হোটেল বের হবার সময়। হুমায়ুন স্যারের বিশাল বহরের খাওয়া দাওয়াসহ সবকিছুই জালাল ভাই ব্যবস্থা করেছিলেন। হুমায়ুন স্যার জালাল ভাই দুজনেই আজ স্মৃতি। আল্লাহ উনাদেরকে বেহেশতে রাখুন। শান্তিতে রাখুন। আমীন।

লেখক : শাহরিয়ার বিপ্লব, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ