জাদুকরী ব্যক্তিত্ব বিচারপতি মুর্শেদ

প্রকাশিত: ১:১৫ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১১, ২০২২

জাদুকরী ব্যক্তিত্ব বিচারপতি মুর্শেদ

রাজিয়া বেগম :: কিছু মানুষ ইতিহাস তৈরি করেন এবং কিছু মানুষ এমন পরিস্থিতি তৈরি করেন যা সুনির্দিষ্ট দিকে তাদের পরিচালিত করে। সৈয়দ মাহবুব মুর্শেদ এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি এ দুটি বিষয়কেই একত্রিত করেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল সুস্পষ্ট। তাই ইতিহাসবিদরা বিচারপতি মুর্শেদকে তাঁর দৃঢ়চেতা ও সাহসী মনোভাব নিয়ে বিচারের রায় প্রদানের জন্য মনে রাখবেন। তাঁর রায়গুলো ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ও তাঁর ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ অনুসারী সরকারের জন্য কাঁটা হয়ে উঠেছিল। দেশপ্রেমের নীতি অনুসরণের জন্য মুর্শেদ ‘জীবন্ত ইতিহাস’ হয়ে আছেন। তিনি ছিলেন হাই কোর্টের বিচারক বা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারক। পরে প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি সেই সময়ের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে বড় বাধা থাকা সত্ত্বেও নির্ভয়ে ন্যায়বিচারের পতাকা সমুন্নত রেখেছিলেন। সাংবিধানিক প্রশ্নে তাঁর সাহসী রায় ঘোষণার মাধ্যমে বিচারপতি মুর্শেদ নিজেকে কেবল জাতীয় পর্যায়ে উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করেননি, বরং স্বাধীন ও নির্ভীক হওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন। নানাভাবে তিনি ছিলেন জনগণের ন্যায়বিচার লাভের আশ্রয়স্থল। কে সালাহউদ্দিন লিখেছেন, একজন বিচারক হিসেবে মাহবুব মুর্শেদ সারা জীবন স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও উৎকর্ষ লাভের আদর্শের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। আরেকজন লেখক বলেছেন, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মুর্শেদ অত্যন্ত যুক্তিবাদী সংবিধানবিষয়ক

আইনজীবী এবং দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে খ্যাতিমান জুরিস্ট ছিলেন। তিনি এ অঞ্চলে মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার পক্ষে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন। এখানে তাঁর দেওয়া যুগান্তকারী রায়ের কয়েকটি উদাহরণ উপস্থাপন করা হলো।
বিচারপতি মুর্শেদ ১৯৫৯ সালে মার্শাল ল সরকারের বিরুদ্ধে প্রথমে আঘাত করেন। তিনি ইপিডিও বাতিল ও অকার্যকর ঘোষণা করেছিলেন। এ কারণে অনেক শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ বেকায়দায় পড়েন। কয়েকজন মন্ত্রীও অপসারিত হয়েছিলেন। বিচারপতি মুর্শেদ এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আদালত যা মীমাংসা করে তা ক্ষমতার অপব্যবহার নয়।’ আবু মাহমুদ মামলায় গভর্নর মোনায়েম খানকে তলব এবং একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। বিচারপতি মুর্শেদ তখন গভর্নরের আইনজীবীদের বলেছিলেন, ‘গভর্নরকে বলুন আমার আদালত ন্যায়বিচারের স্থান, ভীতি সঞ্চারের কক্ষ নয়।’ এটা হচ্ছে তাঁর সাহসিকতার নজির। বিচারপতি মুর্শেদের রায়গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল পান মামলায় দেওয়া রায় যা আন্তর্জাতিক আইনবিদদের মতে আইনি ইতিহাসের অন্যতম সেরা রায়।

আমার নিবন্ধের দ্বিতীয় অংশে একজন মানুষ হিসেবে মুর্শেদের পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করব। তাঁর বাবা ছিলেন বাংলার প্রথম বিভাগীয় কমিশনার। তাঁর মা হচ্ছেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ছোট বোন। তিনি তৎকালীন কলকাতার মেয়র জাকারিয়ার একমাত্র সন্তানকে বিয়ে করেছিলেন। সৈয়দ মাহবুব মুর্শেদ স্কুলে বা প্রেসিডেন্সি কলেজ বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় বরাবরই একজন মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে স্বাক্ষর রেখেছেন। পরে তিনি লিংকন ইন লন্ডন থেকে ব্যারিস্টার হয়ে ওঠেন। ১৯৪২ সালে তাঁর মামা ফজলুল হককে সমর্থন করে লেখা তাঁর নিবন্ধ একই সঙ্গে ‘স্টেটসম্যান’ ও ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যা পাঠকদের মধ্যে সাড়া জাগায়। মুর্শেদের মানবতাবাদী মন তাঁকে ‘আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম’ গঠনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। পঞ্চাশের দশকে তিনি একজন বিচারকের দায়িত্ব পালনকালে রেডক্রসের চেয়ারম্যান ছিলেন। এ ছাড়া তিনি সারা জীবন অনেক আর্থসামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন।

মুর্শেদ ‘লিয়াকত-নেহরু’ চুক্তি প্রণয়নে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যার লক্ষ্য ছিল উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটানো। ঢাকায় ফিরে তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। বিচারপতি মুর্শেদ সাংস্কৃতিক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। সর্বোচ্চ মহলের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি ১৯৬১ সালে সারা দেশে রবি ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের আয়োজন করেছিলেন।

১৯৫৪ সালে মুর্শেদ তাঁর মামার নেতৃত্বে আবুল মনসুর আহমদের সঙ্গে ঐতিহাসিক ২১ দফার খসড়া তৈরি করেছিলেন যা তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত করেছিল। ১৯৬৬ সালের দিকে অগাধ দেশপ্রেমের কারণে তিনি আবারও ঐতিহাসিক ছয় দফার খসড়া চূড়ান্তকরণে ভূমিকা রাখেন। এ ছয় দফার জন্য শেখ মুজিব লড়াই করে জেলে গিয়েছিলেন।

অনেক বর্ষীয়ান ছাত্রলীগ নেতা স্মৃতিচারণা করে বলেছেন, একই বছর কেবল প্রধান বিচারপতি মুর্শেদই তাঁদের বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথি হওয়ার সাহস করেছিলেন। সে অনুষ্ঠানেই মুর্শেদ জেলখানায় আটক শেখ মুজিবের মতোই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য সাহসী ডাক দিয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে মুর্শেদ প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি প্রথম যে কাজটি করেছিলেন তা হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আইনি লড়াইয়ের ব্যবস্থা। এ সময় সৈয়দ মাহবুব মুর্শেদকে রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার একমাত্র গ্রহণযোগ্য প্রার্থী বলে বিবেচনা করা হয়েছিল। ১৯৬৯ সালের শেষ দিকে তিনি গণঅভ্যুত্থানে যোগ দিয়েছিলেন। মূলত তাঁর কারণেই শেখ মুজিব প্যারোল ছাড়াই কারাগারের বাইরে এসেছিলেন। ঐতিহাসিক গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতিত্ব করার সময় মুর্শেদ এক ব্যক্তির একটি ভোটের প্রস্তাব করেছিলেন যা গৃহীত হয়েছিল।

লেখক : গবেষক এবং রিটা, বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা।

সাকিব আহমেদ / ১১ জানুয়ারি

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ