কেন বিকল্প প্রয়োজন

প্রকাশিত: ৯:৪৭ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১১, ২০২২

কেন বিকল্প প্রয়োজন

রফিকুজ্জামান লায়েক

আকাঙ্ক্ষা মানুষের সহজাত বিষয়। আপনার পক্ষে-বিপক্ষের আপনার মতের-অমতের সকলেরই আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে এবং থাকাটা স্বাভাবিক। আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে। তার জন্য মানুষ লড়াই-সংগ্রাম এমনকী, জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকে। আকাঙ্ক্ষা যখন একজন বা অল্পজনের গণ্ডি থেকে বহুজনের হয়ে উঠে এবং তা যদি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের অধিকাংশের হয়, তখন তা জাতীয় চরিত্র ধারণ করে। শুধু তাই নয়। আশা-আকাঙ্ক্ষা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করতে থাকে।

আগে দাস মালিকের নিকট থেকে মুক্ত হবার আশা করতেন দাস সমাজ, জমিদারের অত্যাচারের হাত রেহাই পাবার আশা করতেন কৃষক সমাজ। আর আধুনিককালে মালিকসহ সমাজের। রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের শোষণ ও নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি আশা করেন শ্রমিক শ্রেণিসহ শ্রমজীবী মেহনতি জনগণ। কিন্তু মানুষ তার এই আশা পূরণের জন্য রাজনৈতিকভাবে কখনো ও উপনিবেশ দখলদার কখনও শাসক দুর্বৃত্ত শক্তির বিপক্ষে লড়াই করে। অর্থাৎ লড়াই সংগ্রাম ছাড়া আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের জীবনের লড়াই বহু বছর আগের থেকে চলে আসছে। লড়াই নানাভাবে নানা ধরনের আশা-আকাঙ্ক্ষা জন্য হয়ে থাকে। মানুষের জীবনে লড়াই থেমে থাকে না, পরিস্থিতি বিবেচনায় লড়াইয়ের গতি কম-বেশি হতে পারে। রাজনৈতিকভাবে লড়াই করতে যেয়ে মানুষের সামনে আশা-আকাঙ্ক্ষার নতুন-নতুন উপাদান যুক্ত হয়ে থাকে। আবার যুগ ও স্থান-কাল ভেদে আশার তারতম্যও হতে পারে।

মানুষ লড়াই-সংগ্রাম করে জয়লাভ করে, যখন তার লাভ থেকে বঞ্চিত হয়, তখন নতুন উদ্যোগে নতুনভাবে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে আমরা দেখছি বিজয়ের মধ্যেই পরাজয়ের উপাদান যুক্ত হয়ে যায়। মানুষ স্বাধীনতার আশা নিয়ে ঊপনিবেশিক শক্তি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন দীর্ঘ বছর। বিজয়ের কিছু কাল আগে থেকেই ধীরে-ধীরে মানুষের মনে সাম্প্রদায়িক উপাদান যুক্ত করার চেষ্টা করা হয়। এ ক্ষেত্রে কুচক্রি মহল কিছুটা সফল হলেও লড়াই থামেনি, ব্রিটিশ ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ত্যাগ করেছে। কিন্তু যাবার আগে সুকৌশলে উপমহাদেশকে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢেলে বিভাজন করেছে। সব শেষে হিন্দুর জন্য হিন্দুস্থান আর মুসলমানের জন্য পাকিস্তান। কমিউনিস্ট বামপন্থিরা ছাড়া অন্য সবাই এ ধরনের সাম্প্রদায়িক বিভাজন মেনে নেন। ফলে জয় লাভ করেও লাভ হল না। সকল মানুষ এক হবার বদলে ধর্মীয় পরিচয় কৃত্রিমভাবে সামনে আনার ফলে মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়। কিন্তু সে গুড়েবালি। কৃত্রিমতা দিয়ে মুখরোচক কিছু করা গেলেও তা টিকতে পারেনি। ফলে পাকিস্তান থাকেনি। সব মুসলমানের স্বার্থ এক ছিল না। তাই সব মুসলমান ভাই-ভাই হতে পারেনি। হবার কথাও নয়। ২৩ বছর ধরে মানুষ পাকিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। পাক আমলের প্রায় প্রথম থেকেই মানুষ তার মাতৃভাষা “বাংলা” এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জবাব দিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৫২ সালে মানুষ জীবন দিয়ে ভাষা আন্দোলনে জয়লাভ করেন। তথাকথিত কিছু সভ্রান্ত পরিবারে উর্দু ভাষার ব্যবহার থাকলেও আপামর জনগণের মাতৃভাষা হল বাংলা। ভাষা আন্দোলন নিয়েও ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। হবার কথা নয়। কেননা দেশের আপামর জনতা বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক-শ্রমিক-ক্ষেতমজুরসহ শ্রমজীবি মানুষের ভাষা হল বাংলা। যদিও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার এখনও নিশ্চিত হয়নি। শ্রেণি স্বার্থের কারণেই ইংরেজি ভাষার প্রতি কিছু মানুষের বাড়তি টান রয়েছে। ফলে বিচারালয়সহ চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিক্ষার বাহন বাংলা হয়নি। ভাষা আন্দোলনকে কেউ কেউ সাংস্কৃতিক আন্দোলন বলে চালাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের মধ্যে শ্রমজীবি মানুষের স্বার্থ নিহিত ছিল বলে, এ লড়াইয়ের মধ্যে অর্থনীতিক উপাদানও যুক্ত আছেন। এর বড় উদাহরণ হল ইংরেজি শিক্ষার নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। টাকা পয়সা কামাই করা। শিক্ষাকে বাণিজ্যের উপকরণ করা। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারের যে আন্দোলন তার মধ্যে শ্রেণি স্বার্থ জড়িত রয়েছে। যদিও সাধারণ মানুষ তা চাননি। পুরো পাকিস্তান আমলের মানুষ নানা সময়ে ভিন্ন-ভিন্ন ইস্যুতে নানা আশা নিয়ে লড়াই করেছেন। যার ভিত্তি ছিল ১৯৫২ সালের মাতৃভাষা বাংলা রক্ষার আন্দোলন। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র জনতা লড়াই করেছেন নিজস্ব দাবি নিয়ে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব মানুষকে সংগঠিত করে লড়েছেন সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ভোট ও গণতন্ত্রের দাবিতে। শ্রেণি পেশা ভেদে দাবি ভিন্ন-ভিন্ন হলেও মানুষ আশা করেছিলেন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সরাসরি সংগ্রাম করতে হবে। কেননা বাংলায় চলছিল জাতিগত শোষণ বা মানুষ ১৯৪৭ সালে আশা করেননি। মানুষের ভুল ও ঘুম ভাঙ্গতে বেশি সময় লাগেনি।

বর্তমানে আমাদের দেশের প্রচার হল এক লোক বাঁশিতে ‘ফুঁ’ দিয়ে মানুষকে জাগিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। আরও প্রচার হল একটা দলই সব করে দেন। তাদের একক নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে উক্ত দুই ধরনের প্রচার হলো ইতিহাস বিকৃত করার মতলবে। কেননা এই দুই মতই মহান স্বাধীন যুদ্ধে আপামর জনতা বিশেষ করে কৃষক-শ্রমিক-ছাত্রসহ মেহনতি মানুষের জীবন মরণ-অংশগ্রহণকে নাকচ করে দেয়। এটাও শ্রেণি স্বার্থের কারণে। শাসকমহলের এই ধরনের বক্তব্য ২৩ বছর যাবৎ পাকিদের বিরুদ্ধে মানুষের ধারাবাহিক সংগ্রামের ইতিহাসের স্বীকৃতি নাকচ করে। তারা শুরু নয় মাসের যুদ্ধকেই স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে চালিয়ে দিতে প্রস্তুত।

ইতিহাস সত্য বা মিথ্যা দিয়ে হয় না। একটা হল ইতিহাস আর তার বিপরীতে হল বিকৃত ইতিহাস। বিকৃতি দিয়ে ভবিষ্যতে ইতিহাস রচিত হবে না। হতে পারে না। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে বিকৃত করার মধ্যে দেশের শাসক শ্রেণির উভয় অংশেরই শ্রেণি স্বার্থ জড়িত রয়েছে। সে স্বার্থের সাথে জড়িত হয়েছে অসৎ রাজনীতিক, আমলা ও ব্যবসায়িরা। ৯৯ ভাগ মানুষের সকল সম্ভাবনাকে ধ্বংস করছে। স্বাধীন দেশে তারা স্বাধীনভাবে শোষণ ও লুটপাট করে চলেছে। কিন্তু যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মানুষ যুদ্ধে গেলেন জীবন দান করলেন, মা-বোন সম্ভ্রম হারালেন তার কী হল? এর জবাব পূর্বের অর্থাৎ যুদ্ধের এবং যুদ্ধ জয়ের পরের ঘটনার মধ্যে রয়েছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শেষ পর্যায়ে শ্রেণি-পেশার স্বার্থ একাকার হয়ে যায় জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে। মানুষ ভেবেছিলেন স্বাধীন হলে আমার এবং আমার শ্রেণি স্বার্থ উপেক্ষিত হবে না। কিন্তু তা হয়নি। যুদ্ধের সময় সব বাঙালি, পাহাড়ী আদিবাসী এক হয়েছিলেন এই জন্য যে, আমরা সবাই এক। ফলে শ্রেণি স্বার্থের প্রশ্ন আর থাকেনি। অল্পদিন পরেই স্বাধীন দেশে লুটপাটের ধারা নতুন করে প্রবর্তিত হল। দুঃখজনক হলেও সত্য এই সময় কেউই ঐক্য ও সংগ্রাম-এরকম দ্বৈত নীতি নিয়ে মানুষের নিকট হাজির হননি। কেউ বিরোধিতা করেছেন, ভাল কাজের জন্য ঐকের কথা বলেননি। আবার কেউ শুধু ঐক্যের উপর অতিরিক্ত জোর দিয়েছেন কিন্তু লুটপাটের বিরুদ্ধে সেভাবে সংগ্রাম করেননি। যার জন্য সদ্য-স্বাধীন দেশে মানুষের মধ্যে শ্রেণি স্বার্থের বিভাজন তৈরি হয় অল্প দিনেই। এর মধ্যেও তৎকালীন সরকার জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে যতটুকু উদ্যোগ নিয়েছিলেন- তা বাধাগ্রস্ত হয়। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। তারপর মানুষ রাস্তায় নেমেছেন সামরিক স্বৈর-শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্য। শ্রমজীবি মানুষও বসে থাকেননি। যার যার শ্রেণি পেশার জন্য সংগ্রাম নেমেছেন। আশা নিয়ে মানুষ রাস্তায় নেমে রক্ত দিয়েছেন। কিন্তু আশা পূরণ হয়নি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই ব্যবস্থায় আশা পূরণ হবার নয়। শুধু বর্তমান নয় গত প্রায় একশ বছরের ঘটনা এরই প্রমাণ বহন করছে। তা হলে সাধারণের মুক্তি কোন পথে হবে? হবে এবং হতে হবে। স্বাধীনভাবে মান-সম্মানসহ ন্যূনতম হলেও মৌলিক অধিকারের প্রতিষ্ঠার আশা মানুষ সুপ্রাচীন কাল থেকে। কিন্তু সে মুক্তি মানুষ পাননি। কিন্তু মানুষ আট দশকের ও কম সময়ে আমরা দুইবার স্বাধীন হয়েছি, দুইবার গণঅভ্যুত্থান হয়েছে এবং ভাষার জন্য মানুষ অনেক আশা নিয়ে সংগ্রামী করেছেন।

ব্রিটিশকে তাড়াবার সময়ে আমাদের ধর্মের নামাবলি দিয়ে সব মুসলমান ভাই-ভাই বলা হয়েছিল-১৯৭১ সব বাঙালিকে এক হবার আহ্বান করা হয়েছিল। মানুষ সাড়া দিয়ে এক হয়ে যুদ্ধে লড়ে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর দেখা গেল পাঞ্জাবি মুসলমান আর বাংলার মুসলমানের স্বার্থ এক নয়। জাতিগত শোষণ প্রকট। সেজন্যই ১৯৭১ সালে মানুষ বিদ্রোহ করে। কিন্তু সব বাঙালির স্বার্থ এক নয়। লুটপাটকারি, কালোবাজারি, টাকা পাচারকারি, ষড়যন্ত্রকারি আর দুর্নীতিবাজদের স্বার্থ এবং সাধারণ মেহনতকারি বাঙালির স্বার্থ এক নয়। এক হতে পারে না। বর্তমানে মূলদ্বন্দ্ব এখানেই। তবে সাম্রাজ্যবাদি চক্রান্ত ও সাম্প্রদায়িকতাকে আমলে নিয়ে তার বিরুদ্ধেও জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় লড়তে হবে।

বর্তমানে লড়াই হল বিগত প্রায় ৮ দশকের নানা সংগ্রামের বিজয়ের ফসল যা হাতছাড়া হয়েছে বা হচ্ছে-তার পুনঃরুদ্ধার। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থায় ক্ষমতার উভয় অংশ বুর্জোয়া শক্তিকে দিয়ে সম্ভব নয়। সেজন্যই অন্য রাস্তার হাঁটতে হবে। কোন ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে সে পথ নয়। এক জনের পরিবর্তে আরেক জন নন। গোটা ব্যবস্থার আমূল সংস্থারের জন্য কমিউনিস্ট-বামপন্থিদেরই এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। আর এ দায়িত্ব হল ইতিহাসের অনিবার্য ফল। জাতীয় স্বার্থ ও শ্রেণি পেশার স্বার্থের লড়াইকে সমান গুরুত্ব দিয়েই আঘাত হানতে হবে। লড়াই নানা ফর্মে নানা ইস্যুতে হবে। কিন্ত লক্ষ্য একটাই মেহনতকারি সাধারণের জন্য বিকল্প শক্তি সমাবেশ গড়ে তোলা। যা ইতিহাসের দাবি- বিকল্পেই মুক্তি।

লেখক: প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সংবাদ অনুসন্ধান ক্যালেন্ডার

MonTueWedThuFriSatSun
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031   
       
1234567
15161718192021
293031    
       
22232425262728
2930     
       
  12345
2728     
       
28      
       
       
       
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930     
       

আমাদের ফেইসবুক পেইজ