গণমানুষের পরম বন্ধু ছিলেন সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান
প্রকাশিত: ১২:০০ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ২১, ২০২০
মোঃ আব্দুল মুনিম জাহেদী ক্যারল: সিলেটের রাজনীতিতে বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান ছিলেন গণমানুষের কাছের মানুষ। নিবিড় ভাবে দেখেছি, মিশেছি এবং সুখ-দুঃখের সাথী হয়েছি। মানুষের বান্ধব ছিলেন তিনি। বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান ছিলেন তৃণমূল থেকে ওঠে আসা এক নন্দিত জননেতা। গণমানুষের রাজনীতিতে যেসব গুণ থাকা দরকার তার সবই ছিল বদর উদ্দিন আহমেদ কামরানের মধ্যে। ব্যাক্তিগত জীবনে খুবই সাদামাটা চলাফেরায় অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। কামরান এমন একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন যার কাছে দলমত নির্বিশেষে সবার দুয়ার ছিলো খোলা। যা তাকে জনপ্রিয় ও সবার কাছে প্রিয় করে তুলে। আমি অনেক ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী হয়েছি । সিলেট নগরীতে জনতার কামরান হিসেবে পরিচিতি ছিল তাঁর। ব্যক্তিগত জীবনে এই মানুষটি খুবই সহজে সবাইকে আপন করে নিতেন । তাঁর অমায়িক ব্যবহারে বিপক্ষীয় মানুষজনও মুগ্ধ হয়ে যেত। তাঁর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় সত্তর দশকের শেষের দিকে। তখন আমি স্কুলে পড়ুয়া একজন টগবগে যুবক, হাই স্কলে লেখা পড়া করছি। তখনকার সময় আমাদের স্কুলে পড়ুয়া আর কোন শিক্ষার্থী ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত ছিল বলে আমার জানা নেই। তবে আমি খুবই সক্রিয় ছিলাম। বাবা ছিলেন বিলেত আর আমার ছিল ফ্রিডম পাস, অনেকটা স্বাধীন ছিলাম । সেই ছোট বেলা থেকেই স্কুল ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন রাজনীতিক অনুষ্ঠানে আমার উপস্থিতি ছিল সরব। আমি লেখাপড়ায় অমনোযোগী, খেলাধুলা, সংস্কৃতি ও ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। অষ্টম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় আমাদের স্কুলের আর কোনো ছাত্র এ পথে ছিল বলে আমার জানা নেই। বিশিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা ফুলবাড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগ নেতা আব্দুল বাছিত ভাই, প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও ফুলবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম চেয়ারম্যান সামছুদ্দীন আহমদ খেতু মিয়া ভাই, প্রবীণ রাজনীতিবিদআব্দুল ওয়াহাব ভাই, আওয়ামীলীগ নেতা আবু নাসের জামাল খান ভাইদের হাত ধরে আমার ছাত্র রাজনীতির শুরু হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় কোন একদিন একবার স্কুল ফাঁকি দিয়ে তাদের সাথে সিলেটের ঝেরঝেরি পাড়ার মনির আলী কন্ট্রাক্টর সাহেবের বাসায় এক গোপন বৈঠকে গিয়েছিলাম। তখন সাবেক পররাষ্টমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ কারাগারে ছিলেন। উনার কারা মুক্তির জন্য কর্মসূচি পালনে ছিল সেই মিটিং। আজও মনে আছে, তখন আমাদের শ্লোগান ছিল “জেলের তালা ভাঙবো, সামাদ ভাইকে আনবো” ইত্যাদি । এভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে আরো অনেক দিন স্কুল ফাঁকি দিয়েছি। ঐ দিন মনির আলী কন্টাকটার সাহেবের বাসায় সিলেটের অনেক প্রবিন রাজনীতিবিদের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম আমি। বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ভাইকেও সেদিন প্রথম দেখেছিলাম। তবে এখানকার মত সফেদ পাঞ্জাবি ও ঢোলা পায়জামা পড়া ও মাতায় টুপি পড়া নয়, তখন প্যান্ট সার্ট পড়া টগবগকে একজন যুবক ছিলেন। তৎকালীন সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান বাবরুল হোসেন বাবুলও ছিলেন তাদের সাথী । সিলেট পৌরসভার নির্বাচনের সময় বাবরুল হোসেন বাবুল ভাইর মিছিলে অনেক সময় একসাথে ছিলাম। আমার সাথে আমার চাচাত ভাই লবু ও মুজিব ছিল। আমরা একসাথে বাড়ি থেকে বের হই মিছিলে যোগ দেয়ার জন্য, সে এক অন্যরকম আনন্দ। মিছিল মিটিং ছিল নিত্যদিনের আনন্দময় বিষয়। কামরান ভাই ছিলেন সিলেট নগরীর ছড়ারপারের বাসিন্দা। প্রথম নির্বাচনে অংশ নেন ১৯৭৩ সালে। তৎকালীন সিলেট পৌরসভার ৩ নং তোপখানা ওয়ার্ডের কমিশনার নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল কামরান ভাইয়ের জনপ্রতিনিধি হিসেবে পথচলা। পরে ১৯৯৫ সালে পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন । এরপর থেকে অনেক বার কামরান ভাইয়ের সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছিল। যতবারই এই উদার মনের মানুষের সাথে দেখা হত খুব আপন করে গ্রহন করতেন তিনি। ২০০৬ সালে পবিত্র কাবা শরিফে একাধিকবার দেখা ও কথা হয় হজ্ব পালনের সময়। প্রায়দিনই দেখা হত কাবা শরিফের মেইন গেইটের বাইরে খুলা মাঠে জায়নামাজে বসে জিকীর আজকার করতেছেন। আমার এক ব্যবসায়ীক পার্টনার মাসুদ জামানও তাঁর সফর সংগী ছিলেন। আমার স্বাসুড়ী ও ছোটভাই (স্রির ভাই) সাদিক আহমেদ সাবু, আমার এক বড় ভাই আব্দুল অদুদসহ আমরা অনেকেই একসাথে হজ্ব পালনকারী ছিলাম। ২০০৭ সালে লন্ডনে সুধু সিলেট কেন্দ্রিক সর্ববৃহৎ আবাসন মেলা সফল করার জন্য তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করি কুয়ার পাড়ার বাসায়। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলসহ আমরা প্রায় ১০/১২ জনের একটি গ্রুপ একসাথে ছিলাম। সিলেটের উন্নয়নে দল মত নির্বিশেষে এক হয়ে আবাসন মেলা সফলভাবে পরিচালনার জন্য তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল। সিলেটের আবাসন ব্যাবসায়িদের সহযোগিতায় লন্ডন মুসলিম সেন্টারে আবাসন মেলাটি সফল ও স্বার্থক হয়েছিল। তা অবশ্যই স্বরণীয় হয়ে থাকবে আবাসন ব্যাবসায়িদের হৃদয় জুড়ে। সাবেক ছাত্রনেতা শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল ভাইসহ অনেকেই লন্ডনের ঐ আবাসন মেলায় উপস্থিত ছিলেন।
এরপরে ২০১০ সালে বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ভাইর সাথে দেখা হয় পূর্ব লন্ডনের মাইক্রো বিজনেস পার্কে। সপ্তাহিক জনমতের সহকারী সম্পাদক আমার প্রিয় বন্ধু মুসলেহ ভাইয়ের ‘ফেইথ’-বিজনেসে। এই ফেইথে দেশের রথী মহারথীরা লন্ডনে আসলে একবার হলেও ঢু মারতেন। বলা যায়, লন্ডনের রাজনীতি, ব্যবসায়ী ও সংস্কৃতি পরিমণ্ডলের অনেকের নিয়মিত আনাগোনা চলে এই ফেইথে। স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা জামাল আহমদ খান ও অন্যান্য নেতাদের সাথে কামরান ভাইর উপস্থিতি ছিল ঐ দিন। প্রথমে অফিসে ঢুকে সবাইকেই চেনেন এমন ভঙ্গিতেই হাই হ্যালো দেয়া শুরু করলেন। অনেককেই চেনেন আবার অনেককেই চেনেন না। কিন্তু যেভাবে কথা বলছিলেন তার চেনা ও অচেনা মানুষের মধ্যে আলাদা করার সাধ্য কারো ছিল না। সবার সাথেই হেসে হেসে কথা বলছেন। এই ছিল তাঁর অসাধারণ গুণ। সেদিন অনেক কিছুই আলোচনা হয়, আমরা সবাই মুগ্ধ হয়েছিলাম তাঁর মধুর ব্যবহারে! ২০১৯ সালের জানুআরি মাসে তাঁর সাথে দেখা হয় আমার গ্রাম হিলালপুরে। রেজিয়া রহিম ওয়েলফেয়ার এন্ড এডুকেশন ট্রাস্ট, হিলালপুর শাপলা সমাজ কল্যাণ সংঘ, ও আবেয়া খানম ব্রিলিয়্যান্স কেয়ার এর সৌজন্যে এবং আমার ও গোলাপগঞ্জ এডুকেশন ট্রাস্ট, ইউ কের সহ সভাপতি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনের সার্বিক তত্বাবধানে গোলাপগঞ্জ উপজেলাধীন প্রতিবন্ধীদের ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও সচেতনতা বিষয়ক কর্মশালা দিনব্যাপী অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলাম। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ভাই। অতিথি হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন গোলাপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি এডভোকেট ইকবাল আহমেদ চৌধুরী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জাদুশিল্পী শাহিন শাহ, গোলাপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি আব্দুর রহমান, জালালাবাদ এসোসিয়েশন ইউকে’র সেক্রেটারি আমিনুল হক জিল্লু, এডভোকেট বিজয় কুমার দেব বুলু, আমার স্কুল বন্ধু এডভোকেট দিলওয়ার হোসেন দিলু, খেলাফত মজলিস যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি মাওলানা সাদিকুর রাহমান, সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা: হোসাইন আহমদ, স্টার লাইট একাডেমীর প্রিন্সিপাল আনোয়ার আলি, লন্ডন প্রবাসী আব্দুল হালিম চুনু , গোলাপগজ্ঞ প্রেসক্লাবের সভাপতি আব্দুল আহাদ প্রমুখ। তাদের উপস্থিতিতে ও সুন্দর পরামর্শদানে আমরা অনেক উপকৃত হয়েছি। সর্বশেষ দেখা হয় মহামারি করোনার লকডাউনের মাত্র কিছুদিন পুর্বে । লন্ডনে এসেছিলেন তাঁর ছেলের বিয়ের অনুস্টানে। রবিবার ৮ই মার্চ ২০২০ পুর্ব লন্ডনের ইম্প্রেশন ইভেন্ট হলে বিবাহআসর ছিল, এটাই লন্ডনের তাঁর সর্বশেষ সফর। বদরউদ্দিন আহমদ কামরান একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ সংগঠক ছিলেন। তাঁর অবদানের কথা সিলেটের মানুষ আজীবন মনে রাখবে। তিনি আমৃত্যু মানুষের পাশে থেকে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন মানুষের কল্যাণে। সাধারণ জনগণ ছিল তাঁর পরম আত্মীয়। তিনি জয় করেছেন তাদের মন। কেবল রাজনীতিই নয়, বদরউদ্দিন আহমদ কামরান বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর সঞ্চয় ছিল সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। কর্মময় জীবনের ব্যাপ্তি ছিল বিশাল। তাঁর অবদানের কথা মানুষ চিরদিন স্বরণ রাখবে। সিলেটের যেকোন সংকটে তিনি সবার আগে এগিয়ে আসতেন। করোনা সংকটেও তিনি ঘরে বসে থাকতে পারেন নি। অসহায় গরিব দুঃখিদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত মানুষের তরে নিজের জীবন বিলিয়ে দিলেন। ছোট্ট একটা মুচকি হাসি লেগেই থাকতো সব সময় উনার মুখে। বিশাল গোঁফের ফাঁকে মিহি হাসি এক অপূর্ব ব্যাঞ্জনা তুলত তাঁর বলনে। গুফে সবাইকে মানায় না আবার কাউকে খুব সুন্দর দেখায়। তবে কামরান ভাইয়ের মুখে গুফে খুব মানাতো। তাঁর হাসি ও কথাবলা ভঙি ছিল চমৎকার। দোষে গুনে মানুষ, তবে কামরান ভাইয়ের গুনের পাল্লাই ভারী ছিল এটা আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি। তাইতো মৃত্যুর পরে দল মত নির্বিশেষে সবাই বিলাপ করছেন তাকে হারানোর বেদনায়, আফসোস করেছেন এই গুনি মানুষের জন্য। কামরান ভাইয়ের মতো নেতৃত্ব সিলেট ধরে রাখুক। দেশের শীর্ষ নেতৃত্বেও এমন গুনের চর্চা চলুক। গণমানুষের পরম বন্ধু বদরউদ্দিন আহমদ কামরান এর মৃত্যুর পরও তিনি বেঁচে থাকবেন বহু মানুষের মনের মণিকোঠায়, অনেকের হৃদয়ে। মহান আল্লাহ উনার জান্নাত নসীব করুন। আমীন।