সিলেট ১৫ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩১শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৮:৩৯ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৭, ২০২২
অনলাইন ডেস্ক ::
তৃতীয়বারের মতো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচিত হলেন সেলিনা হায়াৎ আইভী।
দেশের মানুষ অনেক দিন পর একটি ভালো নির্বাচন দেখল নারায়ণগঞ্জে। প্রচার থেকে শুরু করে ভোট গ্রহণ পর্যন্ত প্রায় ১৮ দিন কোনো সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। ছিল না পেশিশক্তির দাপট। শান্তিপূর্ণ এই ভোটে আবারও মেয়র হিসেবে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে বেছে নিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মানুষ।
রিটার্নিং কর্মকর্তার ঘোষিত বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী, মোট ১৯২টি কেন্দ্রে আইভীর প্রাপ্ত ভোট ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৭। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৬২ ভোট। দুই প্রার্থীর ভোটের পার্থক্য ৬৬ হাজার ৫৩৫ ভোট। নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মাসুম বিল্লাহ্ হাতপাখা প্রতীকে পেয়েছেন ২৩ হাজার ৯৮৭, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের এ বি এম সিরাজুল মামুন দেয়ালঘড়ি প্রতীকে ১০ হাজার ৭২৪, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির রাশেদ ফেরদৌস হাতঘড়ি প্রতীকে ১ হাজার ৯২৭, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মো. জসিম উদ্দিন বটগাছ প্রতীকে ১ হাজার ৩০৯ ভোট এবং স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী কামরুল ইসলাম ঘোড়া প্রতীকে পেয়েছেন ১ হাজার ৩০৫ ভোট।
জাতীয় কিংবা স্থানীয় কোনো কোনো নির্বাচনে ভোটারের খরার কথা সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত। মানুষ ভোটের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছেন—এমন কথাও বারবার আলোচিত হচ্ছিল। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ‘বিনা ভোটে নির্বাচন’ বা ‘একতরফা’ নির্বাচনের প্রবণতার পাশাপাশি হানাহানির ঘটনা ঘটছে। এমন অবস্থার মধ্যেই গতকালের নারায়ণগঞ্জের সিটি নির্বাচন ছিল ব্যতিক্রম। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ প্রচার শেষে সম্পূর্ণ গোলযোগমুক্ত এমন ভোট সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি।
পুলিশ, র্যাব, বিজিবির সদস্যরা ছিলেন কড়া পাহারায়। আনসার সদস্যরা কেন্দ্রের ভেতরে-গেটে ভোটারদের সর্বাত্মক সহায়তা করেছেন। ম্যাজিস্ট্রেটরা ঘুরে ঘুরে কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন। স্বস্তি দেখা গেল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যেও। নিজের ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার—দুজনই বারবার ভোটারদের বেশি সংখ্যায় কেন্দ্রে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন। ভোটার এলে জয়ী হবেন এমন আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। শুধু ভোটের ধীর গতি নিয়ে তাঁরা কিছুটা উদ্বেগ জানিয়েছেন।
সকাল আটটায় ভোট গ্রহণের শুরুতেই কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। এর মধ্যে নারী, পুরুষ, বয়স্ক, তরুণ—সব শ্রেণির ভোটারই ছিলেন। বিকেল চারটার দিকে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। ভোট গ্রহণ কর্মকর্তারা সময় শেষ হওয়ার পরও সারি থাকা ভোটারদের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোটদানে অনভ্যস্ততার কারণে ভোট গ্রহণে ধীর গতি ছিল বলে জানিয়েছেন ভোট গ্রহণ কর্মকর্তারা। আঙুলের ছাপ না মেলার কারণে অনেকে ভোগান্তিতে পড়েন।
বিজ্ঞাপন
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বিজয়ী হওয়ার পর সেলিনা হায়াৎ আইভী। গতকাল রাতে নারায়ণগঞ্জের দেওভোগে নিজ বাড়িতে
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বিজয়ী হওয়ার পর সেলিনা হায়াৎ আইভী। গতকাল রাতে নারায়ণগঞ্জের দেওভোগে নিজ বাড়িতে ছবি: দীপু মালাকার
প্রথম আলোর আটজন প্রতিবেদক ও তিনজন আলোচিত্র সাংবাদিক ভোটের মাঠে ছিলেন। তাঁরা ১৯২টি কেন্দ্রের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ শহর, বন্দর ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার মোট ৬৭টি কেন্দ্রে ভোটের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।
বন্দর এলাকার নবীগঞ্জ কদম রসুল গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে সকাল থেকেই ভোটারের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ভোটারের লম্বা সারি থাকায় বিকেল চারটার পরও ওই কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ চলে।
ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ জানিয়ে হুমায়রা নামে এক ভোটার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো ঝামেলা হয়নি। সুন্দরভাবে ভোট দিতে পেরেছি।’
বন্দর এলাকার অনেক কেন্দ্রে বিকেল চারটার পরও ভোট গ্রহণ চলে। শ্রমকল্যাণ কেন্দ্র, বিএম ইউনিয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, শান্তিনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়, মদনগঞ্জ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কবি নজরুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কদম শরীফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অন্যতম। এর মধ্যে মদনগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিকেল সোয়া পাঁচটা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ করা হয়। সিদ্ধিরগঞ্জের এর মধ্যে শিমরাইল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত ভোট দেন ভোটাররা।
শহরের আদর্শ স্কুল কেন্দ্রেও সারা দিনই ভোটারের উপস্থিতি দেখা গেছে। ভোটার লাভলী বেগম বেলা ১১টার দিকে বলেন, সারা দেশের ভোটের অবস্থা দেখে নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। তাঁর দাবি, ‘বিনা বাধায়, নিজের ইচ্ছায় বহুদিন পর ভোট দিতে পারলাম।’
বেলা আড়াইটায় সিদ্ধিরগঞ্জের ধনকুন্ডা পপুলার হাইস্কুল কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, নারী ও পুরুষের আটটি সারি মাঠের শেষ স্পর্শ করেছে।
বেলা ১১টায় নারায়ণগঞ্জ শহরের মরগ্যান গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোটারের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। এখানে ভোটার কামাল হোসেন বলেন, দেড় ঘণ্টা ধরে লাইনে আছেন। পরিবেশ ভালো। তাই সময় লাগলেও ভোট না দিয়ে যাবেন না।
ফল নিয়ে তৈমুর ও আইভীর প্রতিক্রিয়া
রাতে ভোটের ফলাফল প্রকাশের একপর্যায়ে মেয়র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার প্রথম আলোকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় দাবি করেন, ইভিএমের কারসাজিতে তিনি হেরে গেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আগেই বলেছি, প্রশাসন, পুলিশ ও নির্বাচন কমিশন আমার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। আমি ইভিএমের ইন্টারনাল মেকানিজমে হেরেছি।’
ফলাফল ঘোষণা শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যায়, সেলিনা হায়াৎ আইভীই জিততে যাচ্ছেন। রাত ১০টায় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জবাসী আমাকে বিমুখ করেনি। তবে ভেবেছিলাম এক লাখ ভোটে জিতব। তা হয়নি। কারণ, ইভিএমে ভোট হওয়ায় ভোট গ্রহণে ধীর গতি ছিল। পুরো ভোট পড়লে এক লাখ ভোটেই জিততাম।’
বিজ্ঞাপন
এই ভোটে যা ব্যতিক্রম
জাতীয় কিংবা স্থানীয় সরকারের ভোটে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু চিত্র ছিল অনেকটা নৈমিত্তিক। ভোটকেন্দ্রের বাইরে সরকারি দলের প্রার্থীর ব্যাজ পরে নেতা-কর্মীদের মহড়া। কেন্দ্রের মুখে জটলা পাকানো। বুথের ভেতর প্রভাবশালী প্রার্থীর সমর্থকদের আনাগোনা। গোপন কক্ষে অবস্থান করে নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট দিতে চাপ দেওয়া। অথবা ইভিএমে ভোট হলে ভোটারের আঙুলের চাপ নেওয়ার পর আরেকজন বাটন চেপে দেওয়া। বিরোধী কারও এজেন্ট এলে বের করে দেওয়া ইত্যাদি।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ভোটে এসবের কোনোটাই দেখা যায়নি। ভোটাররা আতঙ্ক ছাড়াই কেন্দ্রে আসতে পেরেছে। তাঁরা জানিয়েছেন, পছন্দের প্রার্থীকে বিনা বাধায় ভোট দিতে পেরেছেন। ভোট গ্রহণকালে প্রার্থীরাও বড় ধরনের কোনো অভিযোগ করেননি।
দেশে সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে গত বছরের জানুয়ারিতে, চট্টগ্রামে। ওই নির্বাচনে ভোটের দিন ও প্রচারের সময় সহিংসতায় দুজনের প্রাণহানি হয়। প্রচার শুরুর পর থেকেই সংঘাত-সংঘর্ষ লেগে ছিল। চলমান ইউনিয়ন পরিষদের পাঁচ পর্বের ভোটে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন এখানেও ব্যতিক্রম। এমনকি প্রার্থীর পোস্টার ছেঁড়ারও গতানুগতিক অভিযোগ শোনা যায়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিরোধীদের দমনের অভিযোগ দেখা গেছে। নারায়ণগঞ্জে স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং বিএনপির পদ হারানো তৈমুর আলম খন্দকার কিছু কিছু নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তারের অভিযোগ করেছেন। কিন্তু তাঁর সমর্থক ও ঘনিষ্ঠদের মত হচ্ছে, তা ভোটের দিনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি।
একপেশে ভোটেও কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা অতীতে দেখা গেছে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও বড় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। স্থানীয় রাজনীতিকেরা বলছেন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর থাকায় কেউ ঝামেলা করার সাহস পায়নি।
নারায়ণগঞ্জের ভোটার, নাগরিক সমাজ ও স্থানীয় রাজনীতিকেরা বলছেন, প্রধান দুই মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তৈমুর আলম খন্দকার—দুজনই ভোট শান্তিপূর্ণ রাখার বিষয়ে আন্তরিক ছিলেন। দুজনই শান্তিপূর্ণ ভোটকে নিজেদের জয়ের পূর্বশর্ত মনে করেছেন।
অন্যদিকে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে এটি শেষ গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছেন। এই পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকারের অধীনে ভালো নির্বাচন হয়—এমনটা দেখানোর একটা তাগিদ আছে ক্ষমতাসীন দলে।
বিজ্ঞাপন
সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাংসদ শামীম ওসমান পরিবারের দ্বন্দ্ব বেশ পুরোনো। এবারও কিছু সময়ের জন্য দুই পক্ষের বাক্যবিনিময়কে কেন্দ্র করে উত্তাপ তৈরি হয়েছিল। দলীয় সূত্র বলছে, ভোটের দিন যাতে শামীম ওসমানের কোনো তৎপরতা সমালোচনার জন্ম না দেয়, সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এমনকি ভোট দেওয়া ছাড়া তাঁকে বাসা থেকে বের না হওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার নারায়ণগঞ্জ সিটির ভোট পরিদর্শন শেষে গতকাল বিকেল সাড়ে চারটায় ঢাকায় নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে সংবাদ ব্রিফিং করেন। তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরের মধ্যে কুমিল্লার পর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সর্বোত্তম। এ জন্য তিনি নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
[প্রতিবেদন তৈরিতে যুক্ত ছিলেন বিশেষ প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন ও সেলিম জাহিদ, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মো. মহিউদ্দিন ও সামছুর রহমান, নিজস্ব প্রতিবেদক আহমদুল হাসান ও নুরুল আমিন এবং নারায়ণগঞ্জের প্রতিনিধি মজিবুল হক ও গোলাম রাব্বানী]
সুত্র : প্রথম আলো
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ নাজমুল কবীর পাভেল
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : জুমা কবীর মিম
সহ সম্পাদকঃ আরিফ মাহবুব
ব্যবস্থাপনা সম্পাদকঃ আম্বিয়া পাভেল
আইটি সম্পাদক : মাসুম আহমদ
ইমেইল: sylnewsbd@gmail.com, pavel.syl@gmail.com
ফেইসবুক পেইজ : Syl News BD
মোবাইলঃ 01712-540420
শ্রীহট্ট মিডিয়া লিমিটেডের একটি প্রতিষ্ঠান।
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি