সিলেটে আখড়ার সম্পত্তি বেহাত, রক্ষকই ভক্ষক!

প্রকাশিত: ১১:০৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৫, ২০২৩

সিলেটে আখড়ার সম্পত্তি বেহাত, রক্ষকই ভক্ষক!

সিলেটে আখড়ার সম্পত্তি বেহাত, রক্ষকই ভক্ষক!

মুকিত রহমানী

সিলেটের রাধা গোবিন্দ জিউর আখড়ার শুরুতে প্রায় তিন একর জমি ছিল। দিন দিন মূল্যবান হয়ে ওঠে মহানগরের জিন্দাবাজার এলাকার সেই জমি। একসময় তা বেহাত ও দখল হতে থাকে।

আখড়া কর্তৃপক্ষ বলছে, বর্তমানে মাত্র ৪০ শতাংশ জামি তাদের দখলে রয়েছে। দেবোত্তর সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তরের বিধান না থাকলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে আখড়া পরিচালনার দায়িত্বে থাকা লোকজন ওই জমি বিক্রি অথবা হস্তান্তর করেছেন।

স্থানীয়রা বলেন, জিন্দাবাজার এলাকায় এখন প্রতি শতাংশ জমির দাম প্রায় এক কোটি টাকা। এই হিসাবে রাধা গোবিন্দ জিউর আখড়ার প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার সম্পত্তি বেহাত হয়ে গেছে।

১৮৬৮ সালে স্থানীয় বিত্তবান মায়ারাম দাস বৈষ্ণব ‘শ্রীশ্রী রাধা গোবিন্দ জিউর আখড়া’র জন্য প্রায় তিন একর জমি দান করেন বলে স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা জানান। জীবদ্দশায় তিনি মন্দিরটি পরিচালনাও করেন। জিন্দাবাজারের সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও পাঁচপীরের মাজারসংলগ্ন আখড়াটি সিলেট মিউনিসিপ্যালিটি মৌজার জেএল নম্বর ৯১-এর অন্তর্গত।

মন্দিরের সেবায়েত বিভাবসু গোস্বামী বাপ্পা বলেন, ‘তিন একর জায়গার কথা জানা গেলেও মন্দিরের রেকর্ডে রয়েছে ৮৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ জমি। এর মধ্যে দখলে রয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশ, বাকি জমি বেহাত হয়ে গেছে।’

অভিযোগ উঠেছে, সর্বশেষ ২০০৫ সালে বর্তমান পরিচালনা কমিটি মন্দিরের ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ জমি হস্তান্তর করে। সেই জমিতে এখন ক্যাফে নূরজাহান রেস্টুরেন্ট, শাহী বেবি গ্যালারি, ডায়মন্ড হ্যান্ড ও মেসার্স সালাম এন্টারপ্রাইজের অবস্থান। এগুলোর মালিক কুয়ারপাড়ের জনৈক জমির উদ্দিন। তিনি বিভিন্নজনের কাছে পজিশন বিক্রি করেছেন।

বর্তমানে মন্দিরের তেমন কার্যক্রম নেই; পূজা-অর্চনাও কম। ভক্তদের অভিযোগ, মন্দিরের জায়গা থেকে যে আয় হয়, তারও হিসাব দেয় না বর্তমান পরিচালনা কমিটি। সম্প্রতি এ কমিটিকে ‘অবৈধ’ উল্লেখ করে কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে আখড়ার জায়গা বিক্রির অভিযোগ তোলেন কিছু ভক্ত। গত বছরের ৪ ডিসেম্বর ভক্তদের পক্ষে নগরীর মিরের ময়দানের অনন্ত মোহন পাল জেলা প্রশাসক বরাবর ওই অভিযোগ দাখিল করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, আখড়া পরিচালনাকারী বর্তমান কমিটির কোনো বৈধতা নেই। তাদের বিক্রি করা জায়গা উদ্ধারে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান তিনি।

কুয়ারপাড়ের জমির উদ্দিন কীভাবে মন্দিরের জায়গার মালিক হলেন; সে তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, বিরজা মোহন দাস পুরকায়স্থ মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় তাঁর স্ত্রী উষা রানীর নামে ১৯৫৬ সালে মন্দিরের ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ জমি রেকর্ড করিয়ে নেন। পরে উষা রানী বিনিময় দলিলের মাধ্যমে জমির উদ্দিনের কাছে তা হস্তান্তর করেন। এই হস্তান্তরের বিরুদ্ধে ১৯৭৮ সালে আখড়ার পক্ষে আপিল করা হয়। স্বত্ব আপিল (নম্বর-২১৯/১৯৭৮) মামলাটি দীর্ঘদিন চলে। আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির জন্য ২০০৫ সালে সোলেনামা (আপস-মীমাংসার দলিল) তৈরি করেন তৎকালীন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অসিত ভট্টাচার্য। মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার টাকা মন্দিরের অ্যাকাউন্টে জমা দেখিয়ে ওই বছরের ১০ জানুয়ারি সোলেনামার মাধ্যমে জমির উদ্দিনকে সেই জমি হস্তান্তর করেন তিনি। বিষয়টি এত দিন গোপন ছিল।

এদিকে, বর্তমান কমিটির বৈধতা সম্পর্কে জানতে গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর তথ্য অধিকার আইনে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন মন্দিরের ভক্ত ও স্থানীয় বাসিন্দা রাহুল দেবনাথ। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জানানো হয়, আখড়ার বর্তমান কমিটির কোনো অনুমোদন নেই। মন্দিরের জায়গা অনুমতি ছাড়া হস্তান্তরের খবরে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর ভক্তদের পক্ষে মিরের ময়দানের অনন্ত মোহন পাল জেলা প্রশাসকের কাছে ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানান। সে আবেদনের ভিত্তিতে তদন্ত হয়। সর্বশেষ সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. সম্রাট হোসেন গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি নিয়ে শুনানি করতে কমিটির সাধারণ সম্পাদক অসিত ভট্টাচার্যসহ ২১ জনকে নোটিশ দেন। অসিত ভট্টাচার্যসহ কমিটির ৫ জন এরই মধ্যে প্রয়াত। গত ২ মার্চ নোটিশের ওপর শুনানি হয়। সেখানে মন্দিরের বর্তমান কমিটি আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি ও জায়গা হস্তান্তরের কথা স্বীকার করে বলে জানা গেছে।

আখড়ার ভক্তরা বলছেন, ১৯৫৬ সালে বিরজা মোহন দাস পুরকায়স্থ মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় স্ত্রীসহ বিভিন্ন ব্যক্তির নামে মন্দিরের জায়গা রেকর্ড করিয়ে নেন। পরে জাল দলিলে দেবোত্তর সেই সম্পত্তি তারা বিক্রি করে দেন। এর মধ্যে ২০০৮ সালে বারাকাত ল্যান্ড নামে একটি হাউজিং প্রতিষ্ঠানের কাছে ১৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ জমি বিক্রি করেন জামতলার জনৈক কৌশিক চৌধুরী। একই এলাকার শিশির কুমার গুপ্ত ১৯৯২ সালের ২৯ নভেম্বর মন্দিরের ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং স্বরেন্দ কুমার নামে আরেক ব্যক্তি ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ জমি বিক্রি করে দেন। এ ছাড়া বর্তমান কমিটি মুক্তিযোদ্ধা গলি এলাকার ২৫ দশমিক ১৯ শতাংশ জায়গা বিক্রি করে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব জায়গায় পরে ভবন, দোকানপাট ও স্থাপনা তৈরি হয়। সম্পত্তি উদ্ধারে মামলা হলেও কোনো অগ্রগতি নেই।

মন্দিরের জায়গা বেহাত হওয়া ও মামলার বিষয়ে বর্তমান কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট কিশোর কুমার কর বলেন, ‘আমি দায়িত্ব পাওয়া বেশি দিন হয়নি। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দিবাকর ধর রাম ও মামলা পরিচালনাকারী সেবায়েত বিভাবসু গোস্বামী বাপ্পার সঙ্গে কথা বলুন।’ দিবাকর ধর এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। বিভাবসু বলেন, ‘মন্দিরের রেকর্ডভুক্ত ৮৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ জায়গার মধ্যে এখন মাত্র ৪০ শতাংশ দখলে রয়েছে। বাকি সব বেহাত।’ জমি উদ্ধারে কয়েকটি মামলা চলছে বলে জানান তিনি।

সিলেট জেলা বারের আইনজীবী নাজমুল হুদা খান বলেন, ‘দেবোত্তর সম্পত্তি আইন-২০২২ অনুযায়ী এ ধরনের সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তরযোগ্য নয়। তবে ধর্মীয় কাজের জন্য কিংবা মন্দির বা আখড়ার উন্নয়নে অনুমতিসাপেক্ষে বিক্রি বা হস্তান্তর করা যায়। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সেবায়েত ও জেলা প্রশাসকের অনুমতি লাগে।’

ভক্ত রাহুল দেবনাথ অভিযোগ করেন, বর্তমান পরিচালনা কমিটি রাধা গোবিন্দ জিউর আখড়ার সম্পত্তি লুটপাট করেছে। বিক্রি বা হস্তান্তরে কারও কোনো অনুমতি নেয়নি। তিনি আইনিভাবে এটি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান।

সুত্র : সমকাল

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ