শেখ রাসেল : একটি বিয়োগান্তক অধ্যায়

প্রকাশিত: ৮:২৪ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৮, ২০২৩

শেখ রাসেল : একটি বিয়োগান্তক অধ্যায়

শেখ রাসেল (ফাইল ছবি)

শেখ রাসেল : একটি বিয়োগান্তক অধ্যায়

ড. মো. মতিউর রহমান

 

শেখ রাসেল একটি নিষ্পাপ শিশুর নাম। ব্যক্তিগত জীবনে সে ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র। মাত্র দশ বছরের এই শিশু রাজনীতির আশেপাশে না থাকলেও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে ঘাতকরা তাকে রেহাই দেয়নি। মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তাকে খুন করে। এ যেন চৌদ্দশ বছর আগে সংঘটিত কারবালার পুনরাবৃত্তি। সে সময় হযরত মুহাম্মদ (সা.) -এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা.) -এর সঙ্গে খুনিরা তাঁর শিশুপুত্র আসগরকে যেমন খুন করেছিল, পঁচাত্তরের সীমাররা তেমনই শিশু রাসেলকেও হত্যা করে। আসগরের মতোই শিশুর রাসেলও পরিবার সকল সদস্যের সঙ্গে শাহাদতবরণ করেন। ইতিহাসের এই বর্বরোচিত দুটি হত্যাকান্ডের একটি সংঘটিত হয়েছিল কারবালার ফোরাত নদীর তীরে, আরেকটি হয়েছে ঢাকার ধানমন্ডি লেকের তীরে। এ ধরনের হত্যা একাধারে অমানবিক এবং পবিত্র ধর্ম ইসলামে পুরোপুরি নিষিদ্ধ।

শেখ রাসেল হত্যা কতটা স্পর্শকাতর তা আমরা সাম্প্রতিককালে প্রত্যক্ষ করেছি। প্রয়াত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ মৃত্যুর কিছুদিন আগে ‘দেয়াল’ নামে একটি উপন্যাস লিখে গেছেন। দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত অবস্থায় ১৯৭৫ -এ সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য রাজনৈতিক ঘটনার পটভ‚মিতে রচিত এ উপন্যাসে বর্ণিত শেখ রাসেল হত্যা নিয়ে শুধু বিতর্ক নয়, বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমির বইমেলায় ‘দেয়াল’ বই আকারে পাঠকের হাতে পৌঁছে। কিন্তু তার আগেই হুমায়ূন আহমেদ মারা যান। তার মৃত্যুর আগে উপন্যাসের তিনটি অধ্যায় তিনি একটি জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোতে ছাপাতে দেন। আমেরিকায় ক্যান্সারের চিকিৎসা নেওয়ার ফাঁকে লেখক যখন দেশে আসেন তখন উপন্যাসের দুটি অধ্যায়, ওই পত্রিকায় ১১ মে ২০১২ তারিখে প্রকাশিত হয়। তবে উপন্যাসের দুটি অধ্যায় পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার মাত্র তিন দিনের মাথায় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ওই উপন্যাস প্রকাশের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বেঞ্চ উপন্যাস সংক্রান্ত একটি সুয়োমোটো রুল জারি করে। তাতে বলা হয় বঙ্গবন্ধুর ছোটছেলে রাসেল হত্যা সম্পর্কে উপন্যাসে যে কথা বলা হয়েছে সেটা সঠিক নয়। এই ভূল সংশোধন না করা পর্যন্ত লেখক উপন্যাসটি প্রকাশ করবেন না বলে হাইকোর্ট আশা করে। একই সঙ্গে আদালত রাসেল হত্যা সম্পর্কিত সব দলিলপত্র হুমায়ূন আহমেদকে দেওয়ার নির্দেশ দেয় যাতে লেখক সেগুলোর মাধ্যমে তার ভুল সংশোধন করতে পারেন।
দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত ‘দেয়াল’ উপন্যাসে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু দুই পুত্রবধূ তাদের মাঝখানে শিশুর রাসেলকে নিয়ে বিছানায় জড়াজড়ি করে শুয়ে থরথর করে কাঁপছিল। ঘাতক বাহিনী দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকল। ছোট রাসেল দৌড়ে আশ্রয় নিল আলনার পিছনে। সেখান থেকে শিশু করুণ গলায় বলল, তোমরা আমাকে গুলি করো না। কিন্তু শিশুটিকে তার লুকানো জায়গা থেকে ধরে নিয়ে গুলিতে ঝাঝরা করে দেওয়া হল।

বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র রাসেল হত্যা সংক্রান্ত ‘দেয়াল’ উপন্যাসে বর্ণিত এই অংশের বিরোধিতা করে অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে জানান, দলিলপত্র এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে খুনিরা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের ১৩ জন সদস্যকে হত্যা করে। তারা শেখ রাসেলকে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী এএফএম মোহিতুল ইসলামের কাছ থেকে এই বলে ছিনিয়ে নেয়, তারা তাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাবে। সেই সময় রাসেল মোহিতুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করে তারা তাকে মেরে ফেলবে কিনা। মোহিতুল তাকে বলেন, ওরা সেটা করবে না। কিন্তু ঘাতকরা রাসেলকে নিচেরতলা থেকে দোতলায় নিয়ে হত্যা করে। ‘দেয়াল’ প্রকাশের ক্ষেত্রে আদালতের নিষেধাজ্ঞা আরোপের সময় হুমায়ূন আহমেদ দেশেই ছিলেন, তবে এ নিয়ে তাকে তেমন উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি।

তবে জাতীয় দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওই উপন্যাস প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, “দেশের উচ্চ আদালত আমাকে কিছু জিনিস পরিবর্তন করতে বলেছে। তাদের প্রতি সম্মান রেখে আমি অবশ্য সেটা করব। আগস্ট খুব পুরনো ঘটনা নয়। আমি বাদশা নামদার লিখতে পারি কারণ ওগুলো অনেক পুরনো কোন ঘটনা। কিন্তু অল্প পুরনো বিষয় নিয়ে লিখলে সেটা শতভাগ নিখুঁত হওয়া উচিত” অন্যদিকে প্রায় একই সময় দৈনিক যায়যায়দিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, “হুমায়ূন আহমেদের (তখনও জীবিত) উপর আমার আস্থা আছে। তার কাছে এটাই প্রত্যাশা তিনি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্তক ঘটনাটিকে এমনভাবে তুলে ধরবেন যাতে জাতির চেতনা জাগ্রত হয়।”

একই সাক্ষাৎকারে তদানীন্তন অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, হুমায়ূন আহমেদকে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পেপার বুক দেওয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ১৯৯৮ সাল থেকে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা মামলার প্রক্রিয়ায় জেলা জজ পর্যায় ৬১ দিন, হাইকোর্টে ৬৩ দিন, তৃতীয় বিচারক বেঞ্চে ২৩ দিন ও মহাজোট সরকার গঠনের পর আরো ২৫ দিন শুনানি চলে। এই শুনানিতে বাদী ও স্বাক্ষীদের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত চিত্র উঠে এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ছিল শিশু রাসেল হত্যার ঘটনাটি। যা শুনে মামলার শুনানির একপর্যায়ে তিনি নিজেও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন।

সে ঘটনা প্রসঙ্গে মাহবুবে আলম বলেন, “বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী মোহিতুল ইসলামের বক্তব্যে জানা যায় রাসেলকে যখন নিচে নামিয়ে এনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় তখন সে বার বার মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল। এক পর্যায়ে তাকে ভেতরে পাঠানো হয়। এর পরক্ষণেই শোনা যায় গুলির শব্দ। পরে ভেতরে গিয়ে দেখা যায় রাসেলের মরদেহ। একটি চোখ বের হয়ে এসেছে, মস্তিষ্ক ছিন্নভিন্ন।” মাহবুবে আলম আরো বলেন, “সেদিন আমি আদালতে কেঁদেছিলাম। একজন অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে কাঁদছেন এমন দৃশ্য হয়তো অনেককে অবাক করেছে কিন্তু আমি আমার আবেগ ধরে রাখতে পারিনি। এই রাসেল হত্যার অংশটুকু হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের যেভাবে এসেছে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়, সেকারণেই আমি তা আদালতের গোচরে এনেছি।”

বলাবাহুল্য, শেখ রাসেল হত্যার বিষয়ে যথাযথ সংশোধনীর পর ‘দেয়াল’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। তবে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের বক্তব্য থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি, শেখ রাসেল হত্যা কতটা স্পর্শকাতর। যে কোনো শিশু হত্যা আমাদের কাম্য নয়। উপরন্ত শেখ রাসেল ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র। বঙ্গবন্ধু তাঁর ছোট ছেলের নাম রেখেছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক-দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেলের অনুসারে। যিনি বিশ শতকের বিশিষ্ট মনীষী হিসেবে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় পারমাণবিক যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ছোট ছেলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর কতটা টানছিল সেটা আমরা আঁচ করতে পারি বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ রেহানার স্মৃতিচারণ থেকে, “আব্বা খুব আদর করতেন ওকে। বাইরে থেকে ঘরে ফিরেই প্রথম রাসেলকে খুঁজতেন। ওকে কোলে বসিয়ে কত কথা বলতেন। রাসেলও কত কথা জিজ্ঞেস করত।” শেখ রেহানা বলেন, “আব্বা তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দি। যেদিন সবাই মিলে মায়ের সাথে কেন্দ্রীয় কারাগারে আব্বাকে দেখতে যেতাম সেদিন রাসেল ফেরার সময় খুব কাঁদত। একবার খুব মন খারাপ করে ঘরে ফিরল। জিজ্ঞেস করতে বলল আব্বা আসলো না। বলল ওটা তার বাসা এটা আমার বাসা। এখানে পরে আসবে। (শেখ রেহানা- রাসেল আমার ভালোবাসা- ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘রাসেল : হারিয়ে যাওয়া প্রজাপতি’ জাতীয় শিশু দিবস ১৭ই মার্চ ২০১২) বঙ্গবন্ধু নিজেও রাসেল সম্পর্কে অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। জেলখানায় বন্দি অবস্থায় লেখা ‘কারাগারের রোজ নামচা’ বইতে আমরা দেখেছি তিনি অনেকবার রাসেলের কথা বলেছেন। ছোট্ট ছেলেটি তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ছিল। পিতা হিসেবে তাকে সময় দিতে না পারার জন্য মাঝে মধ্যে বঙ্গবন্ধু নিজেকে বিবেকের কাঠগড়ার দাঁড় করাতেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনে কখনো বিশ্বাস করতে পারেননি যাদের জন্য বছরের পর বছর জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, ফাঁসির ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন সেই বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে। যে কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি নিজের নিরাপত্তা নিয়ে কখনো মাথা ঘামাননি। বঙ্গবন্ধু কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি যে বাঙালিদের মধ্যে ঘাপটি মারা মোনাফেক শুধু তাঁকেই নয়, তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে অতি প্রিয় ছোট্ট শিশু রাসেলকেও হত্যা করবে! আসলে এটা যেকোন বিবেকবান মানুষের পক্ষে কখনো কল্পনা করাও দূরহ ছিল। শেখ রাসেলের বর্বরোচিত হত্যা আমাদের কাছে অত্যন্ত হৃদয়বিদারক হয়ে ওঠে যখন তারই বড়বোন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে শুনতে পাই, “১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেট কেড়ে নিল ছোট্ট রাসেলকে। মা, বাবা, দুই ভাই, দুই ভাবী, চাচা সকলের লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে ঘাতকরা সকলের শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল রাসেলকে। ঐ ছোট্ট বুকটা কি কষ্টে বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল? যাদের সান্নিধ্যে ¯েœহ আদরে হেসেখেলে বড় হয়েছে নিথর দেহগুলো পড়ে থাকতে দেখে ওর মনের মধ্যে কি অবস্থা হয়েছিল, কী কষ্টই না ও পেয়েছিল। কেন কেন কেন আমার রাসেলকে এত কষ্ট দিয়ে কেড়ে নিল ঘাতকরা? আমি কি কোনদিন এই কেনোর উত্তর পাবো?” (শেখ হাসিনা, আমাদের ছোট্ট রাসেল সোনা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘রাসেল : হারিয়ে যাওয়া প্রজাপতি, প্রাগুক্ত)

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই প্রশ্নের মুখে আমরা সত্যিই নির্বাক, জবাব দেওয়ার কোনো ভাষা আমাদের নেই। তবে সান্তনা এই যে দেশরত্ন শেখ হাসিনা নেতৃত্বে আমরা খুনিদের রক্ষাকবচ কুখ্যাত ইনডেমনিটি অ্যাক্ট বাতিল করে যথাযথ বিচারের মাধ্যমে জাতিকে অভিশাপমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। শেখ রাসেলের ঘাতকদের ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছি।

লেখক : সিনিয়র কমিশনার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
সদস্য, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড পরিচালনা পর্ষদ

বিডি-প্রতিদিন

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সংবাদ অনুসন্ধান ক্যালেন্ডার

MonTueWedThuFriSatSun
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031   
       
1234567
15161718192021
293031    
       
22232425262728
2930     
       
  12345
2728     
       
28      
       
       
       
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930     
       

আমাদের ফেইসবুক পেইজ