মহাকবি ইকবালের জীবনদর্শন

প্রকাশিত: ৮:৪৭ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৯, ২০২৪

মহাকবি ইকবালের জীবনদর্শন

মহাকবি ইকবালের জীবনদর্শন

 

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
ভারতবর্ষের অন্যতম কবি, দার্শনিক এবং রাজনীতিবিদ আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল জন্মগ্রহণ খরেন ১৮৭৩ সালের ৯ নভেম্বর পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোটে।
আল্লামা ইকবাল ছিলেন বিভাগপূর্ব ভারতবর্ষের একজন প্রথিতযশা কবি, দার্শনিক এবং রাজনীতিবিদ। তাঁর ফার্সি ও উর্দু কবিতা আধুনিক যুগের ফার্সি ও উর্দু সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ইকবাল তাঁর ধর্মীয় ও ইসলামের রাজনৈতিক দর্শনের জন্যও বিশেষভাবে সমাদৃত ছিলেন। তাঁর একটি বিখ্যাত চিন্তা-দর্শন হচ্ছে ভারতের মুসলমানদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন। এই চিন্তাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছিল। তাঁর নাম মুহাম্মদ ইকবাল হলেও তিনি ‘আল্লামা ইকবাল’ হিসেবেই সুপরিচিত। আল্লামা শব্দের অর্থ হচ্ছে শিক্ষাবিদ। তাঁর ফার্সি সৃজনশীলতার জন্য ইরানেও তিনি ছিলেন সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি ইরানে ইকবাল-ই-লাহোরী নামেও পরিচিত
ইকবালের পিতামহ শেখ রফিক কাশ্মির থেকে শিয়ালকোটে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। শেখ রফিক কাশ্মিরী শাল তৈরি এবং ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। তাঁর দুই পুত্র ছিলেন শেখ গোলাম কাদির এবং শেখ নূর মোহাম্মদ। শেখ নূর মোহাম্মদ হচ্ছেন ইকবালের পিতা। তিনি ছিলেন শিয়ালকোটের নামকরা দর্জি। শেখ নূর মোহাম্মদ কেবল পেশাগত দিক দিয়ে নয়, চিন্তাধারা এবং জীবনযাপনে ছিলেন ইসলামের প্রতি অত্যন্ত নিবেদিত-প্রাণ। সূফী-সঙ্গীদের কাছে তিনি ছিলেন সম্মানের পাত্র। তাঁর স্ত্রী, মোহাম্মদ ইকবালের মা ইমাম বিবিও ছিলেন ধার্মিক মহিলা। এই দম্পতি তাদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে ইসলাম ধর্মের প্রতি গভীর অনুভূতির জন্ম দিয়েছিলেন।
পাঞ্জাবের বৃটিশ আর্মির কাছে শিখদের পরাজয়ের পর খ্রিষ্টান মিশনারিরা শিয়ালকোটে শিক্ষা প্রচারের ওপর গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। এ সময়েই শিয়ালকোটে স্কটিশ মিশন কলেজ স্থাপিত হয়। ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজে লিবারেল আর্টস এর কোর্সসমূহের অধিকাংশই আরবি ও ফার্সি ভাষা মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হতো। যদিও এই সময় বেশিরভাগ স্কুলেই ফার্সি ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার শুরু হতো। এই স্কটিশ মিশন কলেজেই ইকবাল সর্বপ্রথম আধুনিক শিক্ষাপ্রাপ্ত হন।
ইকবাল কাব্য প্রতিভার স্বীকৃতি পান তাঁর শিক্ষক সাইয়িদ মীর হাসানের কাছ থেকে। ১৮৯২ সালে ইকবাল স্কটিশ মিশন কলেজ থেকে তাঁর পড়াশোনা শেষ করেন। একই বছরে গুজরাটি চিকিৎসকের মেয়ে করিম বিবির সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের বিচ্ছেদ হয় ১৯১৬ সালে। এই বিয়েতে ইকবালের তিনটি সন্তান ছিল।১৮৮৫ সালে স্কটিশ মিশন কলেজের পড়াশোনা শেষ করে ইকবাল লাহোরের সরকারি কলেজে ভর্তি হন। দর্শন, ইংরেজি ও আরবি সাহিত্য নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেন। এখান থেকে তিনি স্বর্ণ পদক নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৯৯ সালে যখন তিনি মাষ্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন ততদিনে তিনি সাহিত্য অঙ্গনে পরিচিত ব্যক্তিত্ব।
মাস্টার্স ডিগ্রিতে পড়ার সময় ইকবাল স্যার টমাস আর্নল্ড এর সংস্পর্শে আসেন। এই শিক্ষাবিদ ইসলাম ও আধুনিক দর্শনে বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। ইকবালের জন্য তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেছিলেন। স্যার টমাস আর্নল্ডই ইকবালকে ইউরোপে উচ্চ শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন।
ইকবাল ১৯০৫ সাল থেকে লন্ডনে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন । তিন বছরের আইনের ডিগ্রি লাভ করেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লিঙ্কনস্ ইন থেকে। আর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
বৃটেনে থাকতেই ইকবাল সর্বপ্রথম রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। ১৯০৬ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হবার পরপরই তিনি তাতে যোগ দেন। দলের বৃটিশ চ্যাপ্টারের এক্সিকিউটিভ কমিটিতে নির্বাচিত হন ইকবাল। সৈয়দ হাসান বিলগামী এবং সৈয়দ আমির আলির সাথে তিনি সাব-কমিটির সদস্য হিসেবে মুসলিম লীগের খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করেন!
১৯০৮ সালে ইকবাল ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং লাহোরের সরকারি কলেজে যোগদান করেন। এ সময় একই সাথে তিনি আইন ব্যবসা, শিক্ষাদান ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। কিন্তু মূলত অর্থনৈতিক কারণেই তিনি ১৯০৯ সালে সার্বক্ষণিক আইন পেশায় নিয়োজিত হন। তবে আয় রোজগারের ক্ষেত্রে এখানেও তিনি তেমন ভালো কিছু করতে পারেননি। এর কারণ তাঁর সাহিত্যপ্রীতি এবং সেজন্যে সময় ব্যয় করা। তিনি তাঁর পিতাকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, কবিতার বিনিময়ে কোনো অর্থ তিনি গ্রহণ করবেন না। অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে তিনি সে প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেননি। ইতোমধ্যেই বিখ্যাত কবি ইকবালকে বৃটিশ সরকার তাঁকে “আসরার-ই-খোদায়ী” পুস্তকের জন্য নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন।
আল্লামা ইকবাল অমর হয়ে আছেন তাঁর কয়েকটি কবিতা ও রচনার জন্য। এরমধ্যে আসরার ই খোদায়ী, শিকওয়া ও জবাবে শিকওয়া, দ্য রিকনস্ট্রাকশন অব রিলিজিয়াস থট ইন ইসলাম, বা আল ই জিবরাইল, জাভেদ নামা, ইত্যাদি অত্যন্ত গভীর দার্শনিক ভাব সমৃদ্ধ রচনা।
আল্লামা ইকবালের লেখনিতে যে ইসলামী পুনর্জাগরণের আওয়াজ উঠেছিল তা সম-সাময়িক অনেক ব্যক্তি ও আন্দোলনকে সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর দর্শনে প্রভাবিত হয়েছিলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, যিনি পাকিস্তানের কায়েদে আজম। আল্লামা ইকবাল শিয়া চিন্তানায়কদেরকেও প্রভাবিত করেছিলেন। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের চিন্তানায়ক ড. আলি শরিয়তিও আল্লামা ইকবাল দ্বারা সাংঘাতিক প্রভাবিত ছিলেন।
লেখক- গবেষক, কলামিস্ট, মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১, মোবাঃ ০১৯৬৩৬৭১৯১৭