ফতোয়া মুসলিম জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ

প্রকাশিত: ১০:৪১ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১, ২০২৪

ফতোয়া মুসলিম জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ

ফতোয়া মুসলিম জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ

 

ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা

 

ফতওয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া। যতদিন ইসলাম ও মুসলমান থাকবে, ততদিন ফতওয়াও থাকবে। ইসলামকে জানা ও মানার তাগিদে ফতওয়া জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফতওয়ার অনুসরণ অপরিহার্য।

ফতওয়া পরিচিতি: ফতওয়া অর্থ— রায়, মত, সিদ্ধান্ত। পরিভাষায়— শরিয়ত বিষয়ে শরিয়ত বিশেষজ্ঞের রায় হলো ফতওয়া। মূলত কোনো কাজ বৈধ বা অবৈধ হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহর বিধান জানিয়ে দেয়াই হলো ফতওয়া। আধুনিক পণ্ডিতরা মনে করেন, ইসলামী আইনে বিশেষজ্ঞ কর্তৃক আনুষ্ঠানিক আইনগত মতামত প্রদান হলো ফতওয়া। সামগ্রীক বিবেচনায় বলা যায়— ইসলামী জ্ঞান-গবেষণায় একশ্রেণির মানুষ বিশেষজ্ঞ হবেন, অন্য শ্রেনির মানুষ বিশেষজ্ঞ হবেন না। যারা বিশেষজ্ঞ নন তাদের অনেক বিষয়ে জানার প্রয়োজন দেখা দেবে এটাই স্বাভাবিক। তখন তারা বিশেষজ্ঞ শ্রেনির কাছে জিজ্ঞাসা করবেন। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তোমরা না জানো, তাহলে যারা জানে তাদের জিজ্ঞেস করো।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৪৩)
এরূপ জিজ্ঞাসার জবাবে বিশেষজ্ঞরা ইসলামী নীতিমালা অনুসরণ করে যে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন- সেটিই ফতওয়া। পবিত্র কোরআনে একাধিক স্থানে ফতওয়া শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। যেমন বলা হয়েছে- ‘লোকে তোমার কাছে ফতওয়া জানতে চায়। বলো, পিতা-মাতাহীন নিঃসন্তান ব্যক্তি সম্বন্ধে তোমাদেরকে আল্লাহ ফতওয়া জানাচ্ছেন…।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৭৬)

ফতওয়া নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের রায়: অনেক সময় অযোগ্য ব্যক্তি কর্তৃক ফতওয়া প্রদান ও গ্রাম্য মাতব্বর কর্তৃক বিচার-সালিসের মাধ্যমে ফতওয়ায় অপব্যবহার হয়। এ অপব্যবহারকে কেন্দ্র করেই একসময় হাইকোর্ট কর্তৃক সবধরণের ফতওয়া নিষিদ্ধ হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০০০ সালে নওগাঁয় কিছু অযোগ্য ব্যক্তির ফতওয়ার অপপ্রয়োগের প্রেক্ষিতে ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সব ধরনের ফতওয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন। সে রায়ে বলা হয়, একমাত্র আদালতই মুসলিম বা অন্য কোনো আইন অনুযায়ী আইন সংক্রান্ত কোনো প্রশ্নে মতামত দিতে পারেন। কেউ ফতওয়া দিলে ফৌজদারী কার্য বিধির ১৯০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য হবে। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়। আপিলের এক দশক পর ২০১১ সালের মার্চ মাস থেকে এর উপর পূর্ণাঙ্গ শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষে আপিল বিভাগ ১২ মে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন। তাতে বলা হয়, ‘ধর্মীয় বিষয়ে ফতওয়া দেওয়া যাবে এবং শিক্ষিত লোকেরাই শুধু ফতওয়া দিতে পারবেন। গ্রহণের বিষয়টি হতে হবে স্বতস্ফুর্ত। কারো উপর কোনো শক্তি প্রয়োগ করা যাবে না।’ সংক্ষিপ্ত নির্দেশের শেষে আদালত এও বলেছেন যে, ‘যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট ফতওয়াকে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন সে ঘটনায় দেওয়া ফতওয়াটি অবৈধ।’ পরবর্তীতে সুপ্রিমকোর্ট থেকে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে।

ফতওয়ার অপব্যবহারের কারণ : ফতওয়ার অপব্যবহারের মৌলিক কারণ হলো, প্রথমত. শরিয়তের খুটিনাটি বিষয়ে না জেনে ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন না করে ফতওয়া প্রদান করা। অনেকেই দু-একটি বই পড়ে বা ইলেকট্রনিক্স বা প্রিন্ট মিডিয়া অনুসরণ করে ফতওয়া দেয়ার চেষ্টা করে। বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ আলেমদের তোয়াক্কা না করে বরং ক্ষেত্র বিশেষে তাদের সাথে বিতর্ক করে। এটি জঘন্য অপরাধ ও কিয়ামতের একটি অন্যতম আলামত। দ্বিতীয়ত. সাধারণত দু‘টি বিষয়ে অযোগ্য ব্যক্তি বা গ্রাম্য মাতব্বর কর্তৃক ফতওয়া প্রদান ও তা কার্যকর করার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয় এবং অনেকে ফতওয়াকে এ দুটি বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ মনে করে। অথচ এ দু‘টি বিষয়ের প্রচলিত ফতওয়া ইসলাম সমর্থিত নয়। একটি হলো— বিবাহ বহির্ভুত যৌনাচার। অপরটি হলো— হিল্লা বিয়ে।
বিবাহ বহির্ভুত যৌনাচার বিষয়ক ফতওয়া: বিবাহ বহির্ভুত যৌনাচারের ক্ষেত্রে যে ফতওয়া দেয়া হয় তা হলো, সামাজিকভাবে বয়কট বা একঘরে করে রাখা অথবা ১০০টি বেত্রাঘাত করা ইত্যাদি। সামাজিকভাবে এ ধরনের ফতওয়া প্রদান বা কার্যকর করার কোন বৈধতা কোরআন ও সুন্নাহয় নেই। বিবাহ বহির্ভুত যৌনাচার একটি জঘন্য অপকর্ম এতে কোন সন্দেহ নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না, নিশ্চয় তা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ।’ (সুরা আল-ইসরা, আয়াত : ৩২)

কাজেই সামাজিক ভাবে বিবাহ বহির্ভূত যৌনাচার রোধ করতে ব্যভিচার সংক্রান্ত কোরআন ও সুন্নাহর বর্ণনাগুলো প্রচার করতে হবে এবং ব্যভিচারের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে যৌক্তিকভাবে ও প্রজ্ঞার সাথে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। কোরআন ও সুন্নাহয় উল্লিখিত ব্যভিচারের শাস্তি কার্যকর করার দায়িত্ব সরকারের। ইসলামী শাসন ব্যবস্থা থাকলে সেগুলো কার্যকর হবে। পারিবারিক বা সামাজিকভাবে এসব শাস্তি বাস্তবায়ন করা যাবে না। সামাজিকভাবে এসব কার্যকর করার চেষ্টা করা ফতওয়ার অপব্যবহার।
হিল্লা বিয়ে বিষয়ক ফতওয়া: স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে চুড়ান্ত পর্যায়ের বিচ্ছেদ হওয়ার পর তারা আবার সংসার করতে চাইলে অনেকে হিল্লা বিয়ের ফতওয়া প্রদান করে। অর্থাত্ দ্বিতীয় একজন পুরুষের সাথে সেই মহিলার বিয়ে দিতে হবে এরপর দ্বিতীয় স্বামী তালাক দেবে তারপর প্রথম স্বামী তাকে গ্রহণ করবে। অথচ ইসলামী শরিয়ায় এমন কোনো ফতওয়া নেই। তালাক ইসলামে নিরুত্সাহিত একটি বিষয়। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালার কাছে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট হালাল কাজ হলো— তালাক।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২১৭৫)

একান্তই তালাকের প্রয়োজন দেখা দিলে এক বা দুই তালাক দিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। তাহলে পরবর্তীতে সম্মত হলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বহাল করা যাবে। কিন্তু তিন তালাক দিয়ে ফেললে চুড়ান্তভাবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে যাবে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তালাক হলো দুবার পর্যন্ত- তারপর হয় নিয়মানুযায়ী রাখবে না হয় সহূদয়তার সঙ্গে বর্জন করবে। ….. অতঃপর যদি সে স্ত্রীকে তৃতীয়বার তালাক দেয়, তবে সে স্ত্রী যে পর্যন্ত তাকে ছাড়া অন্য কোন স্বামীর সাথে বিয়ে করে না নেবে, তার জন্য হালাল নয়। অতঃপর যদি দ্বিতীয় স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তাদের উভয়ের জন্যই পরস্পরকে পুনরায় বিয়ে করাতে কোনো পাপ নেই। যদি উভয়ে মনে করে যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করে চলতে পারবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২২৯- ২৩০)

আয়াতের বিধানটি আমরা এভাবে বুঝতে পারি যে, মনে করি “ক” স্বামী আর “খ” স্ত্রী। তাদের বিয়ের পর বিচ্ছেদ ঘটেছে এবং সেটা তিন তালাকের মাধ্যমে চুড়ান্ত বিচ্ছেদ। তাহলে তারা আর কখনো একত্রিত হতে পারবে না। তবে যদি তাদের এ বিচ্ছেদের পর “খ” তার ইদ্দত শেষ করে “গ” পুরুষের সাথে বিয়ে করে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবন সংসার চলতে থাকে। হঠাত্ “গ” মারা যায় অথবা বনিবনা না হওয়ায় “খ” কে তিন তালাক প্রদান করে। সেক্ষেত্রে “খ” এর ইদ্দত পুর্তির পর আবার চাইলে “ক” এর সাথে বিয়ে করতে পারে। আল্লাহ তাআলা এমনটিই বলেছেন। তিন তালাকের মাধ্যমে বিচ্ছেদের পর স্ত্রীকে শর্তের সাথে অন্য পুরুষের সাথে বিয়ে দেয়ার পর আবার তার কাছ থেকে তালাক নিয়ে বিয়ে করার কোন অবকাশ নেই। এভাবে দ্বিতীয় জনের সাথে বিয়ে দেওয়ার নাম হিল্লা বিয়ে। এমনটি নিষেধ। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে হিল্লা বিয়ে করে এবং যার জন্য হিল্লা বিয়ে করা হয়— উভয়কেই রাসুলুল্লাহ (সা.) অভিসম্পাত করেছেন। (তিরমিজি, হাদিস : ১১২০)

তালাক নিকৃষ্ট একটি কাজ। চূড়ান্ত প্রয়োজন হলে এক বা দুইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। তিন তালাক দিলে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ হবে এবং একত্রে ঘর-সংসার করা যাবে না। তবে কাকতালীয়ভাবে স্ত্রীর অন্য স্বামীর সাথে বিয়ে হলে এবং তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটলে বা সেই স্বামী মারা গেলে প্রথম স্বামীর সাথে আবার ঘর বাঁধতে পারবে। শর্তকরে বিয়ে দিয়ে আবার তালাক নিয়ে ঘর বাঁধার নিয়ম নেই। কাজেই এমন ফতওয়ারও কোন অবকাশ নেই। এজন্য হিল্লা বিয়ের ফতওয়া (যা অভিশপ্ত বিষয়) এবং শাস্তি প্রয়োগের ফতওয়া (যা প্রয়োগের অধিকার কেবল রাষ্ট্র বা সরকারের) কেবলই ফতওয়ার অপব্যবহার। এসব ফতওয়ার কারণেই ফতওয়ার প্রতি মানুষের অনাসক্তি তৈরি হয়। সেগুলি সঠিক ফতওয়া নয় আবার ফতওয়া এগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধও নয়। বরং ইসলামী সকল বিষয়ের যথার্থ সমাধানই ফতওয়া। যা মানব জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

বিডি-প্রতিদিন

সংবাদ অনুসন্ধান ক্যালেন্ডার

MonTueWedThuFriSatSun
14151617181920
21222324252627
28293031   
       
1234567
15161718192021
293031    
       
22232425262728
2930     
       
  12345
2728     
       
28      
       
       
       
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930     
       

আমাদের ফেইসবুক পেইজ