দাজ্জালের সঙ্গে দেখা হয়েছিল যে সাহাবির

প্রকাশিত: ১২:০৪ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৪, ২০২৪

দাজ্জালের সঙ্গে দেখা হয়েছিল যে সাহাবির

দাজ্জালের সঙ্গে দেখা হয়েছিল যে সাহাবির

 

হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী। প্রিয় পাঠক বৃন্দ! আজ আমি হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী,আপনাদের সামনে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। তা এমন একটি বিষয়, যা আমাদের সবারই প্রয়োজন বিষয়টি হলো রাসুল (সা.) এর বিখ্যাত সাহাবি তামিম দারি (রা.) এর সঙ্গে দাজ্জালের সাক্ষাৎের বিষয় নিয়ে আলোচনা তুলে ধরবো। হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত মানব জাতির জন্য দাজ্জালের চেয়ে বড় ফিতনা আর কিছু নেই। সে এমন অলৌকিক বিষয় দেখাবে যা দেখে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়বে। দাজ্জাল নিজেকে প্রভু ও আল্লাহ হিসেবে দাবী করবে। তার দাবীর পক্ষে এমন কিছু প্রমাণও উপস্থাপন করবে যে সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগেই সতর্ক করেছেন। হাদিসের ভাষ্যে, ‘সে মানুষের কাছে গিয়ে বলবে, আমি যদি তোমার মৃত পিতা-মাতাকে জীবিত করে দেখাই, তাহলে কি তুমি আমাকে প্রভু হিসেবে মানবে? সে বলবে অবশ্যই মানব। এ সুযোগে শয়তান তার পিতা-মাতার আকৃতি ধরে বলবে, হে সন্তান! তুমি তার অনুসরণ কর। সে তোমার প্রতিপালক’ (সহিহ জামে আস্-সগীর: ৭৭৫২)। কিন্তু মুমিন বান্দাগণ এসব দেখে বিভ্রান্ত হবে না। মিথ্যুক দাজ্জালকে সহজেই চিনতে পারবে এবং আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু দুর্বল ঈমানদার লোকেরা বিভ্রান্তিতে পড়ে ঈমান হারা হবে। তার দলে অংশ নেবে। হাদিসে দাজ্জালের ফেতনার সময় যারা তার অনুসরণ করবে তাদের সম্পর্কে জানানো হয়েছে। হাদিসের বর্ণনামতে, ‘দাজ্জালের অধিকাংশ অনুসারী হবে ইহুদি এবং মহিলা’(মুসনাদে আহমদ)। ‘ইস্পাহানের সত্তর হাজার ইহুদী দাজ্জালের অনুসরণ করবে। তাদের সবার পরনে থাকবে সেলাই বিহীন চাদর’ (মুসলিম- কিতাবুল ফিতান)। হাদিসে দাজ্জালের বিভিন্ন আকৃতি বর্ণনা করা হয়েছে। রসুলের বিখ্যাত সাহাবি তামিম দারি (রা.) এর সঙ্গে তার সাক্ষাত হয়েছে বলেও হাদিসে স্বীকৃত আছে। ফাতেমা বিনতে কায়স (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি মসজিদে গিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সাথে নামায আদায় করলাম। আমি ছিলাম মহিলাদের কাতারে। তিনি নামায শেষে হাসতে হাসতে মিম্বারে উঠে বসলেন। প্রথমেই তিনি বললেন, প্রত্যেকেই যেন আপন আপন জায়গায় বসে থাকে। অতঃপর তিনি বললেন, তোমরা কি জানো আমি কেনো তোমাদেরকে একত্রিত করেছি? তারা বললেন, আল্লাহ এবং তার রাসুলই ভাল জানেন। অতঃপর তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে এ সংবাদ দেয়ার জন্যে একত্রিত করেছি যে তামীম দারী ছিল একজন খৃষ্টান। সে আমার কাছে আগমণ করে ইসলাম গ্রহণ করেছে। অতঃপর সে মিথ্যুক দাজ্জাল সম্পর্কে এমন ঘটনা বলেছে যা আমি তোমাদের কাছে বর্ণনা করতে চাই। লাখ্‌ম ও জুযাম গোত্রের ত্রিশ জন লোকের সাথে সে সাগর পথে ভ্রমণে গিয়েছিল। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার শিকার হয়ে এক মাস পর্যন্ত তারা সাগরেই ছিল। অবশেষে তারা সাগরের মাঝখানে একটি দ্বীপে অবতরণ করলো। দ্বীপের ভিতরে প্রবেশ করে তারা মোটা মোটা এবং প্রচুর চুল বিশিষ্ট একটি অদ্ভুত প্রাণীর সন্ধান পেল। চুল দ্বারা সমস্ত শরীর আবৃত থাকার কারণে প্রাণীটির অগ্রপশ্চাৎ নির্ধারণ করতে সক্ষম হলো না। তারা বলল, অকল্যাণ হোক তোমার! কে তুমি? সে বললো, আমি সংবাদ সংগ্রহকারী গোয়েন্দা। তারা বললো, কিসের সংবাদ সংগ্রহকারী? অতঃপর প্রাণীটি দ্বীপের মধ্যে একটি ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে বললো, হে লোক সকল! তোমরা এই ঘরের ভিতরে অবস্থানরত লোকটির কাছে যাও। সে তোমাদের কাছ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তামীম দারী বলেন, প্রাণীটি যখন একজন লোকের কথা বললো, তখন আমাদের ভয় হলো যে হতে পারে সে একটি শয়তান। তথাপি আমরা ভীত হয়ে দ্রুত অগ্রসর হয়ে ঘরটির ভিতরে প্রবেশ করি। সেখানে আমরা বৃহদাকার একটি মানুষ দেখতে পাই। এত বড় আকৃতির মানুষ আমরা ইতিপূর্বে আর কখনও দেখিনি। তার হাত দু’টিকে ঘাড়ের সাথে একত্রিত করে হাঁটু এবং গোড়ালীর মধ্যবর্তী স্থানে লোহার শিকল দ্বারা বেঁধে রাখা হয়েছে। আমরা বললাম, মরণ হোক তোমার! কে তুমি? সে বললো, তোমরা আমার কাছে আসতে সক্ষম হয়েছ। তাই আগে তোমাদের পরিচয় দাও। আমরা বললাম, আমরা একদল আরব মানুষ নৌকায় আরোহণ করেছিলাম। সাগরের প্রচণ্ড ঢেউ আমাদেরকে নিয়ে একমাস পর্যন্ত খেলা করলো। অবশেষে তোমার দ্বীপে উঠতে বাধ্য হলাম। দ্বীপে প্রবেশ করেই প্রচুর পশম বিশিষ্ট এমন একটি জন্তুর সাক্ষাৎ পেলাম, পশমের কারণে যার অগ্রপশ্চাৎ চেনা যাচ্ছিল না। আমরা বললাম, অকল্যাণ হোক তোমার! কে তুমি? সে বললো, আমি সংবাদ সংগ্রহকারী গোয়েন্দা। আমরা বললাম, কিসের সংবাদ সংগ্রহকারী? অতঃপর প্রাণীটি দ্বীপের মধ্যে এই ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে বললো, হে লোক সকল! তোমরা এই ঘরের ভিতরে অবস্থানরত লোকটির কাছে যাও। সে তোমাদের নিকট থেকে সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তাই আমরা তার ভয়ে তোমার কাছে দ্রুত আগমণ করলাম। হতে পার তুমি একজন শয়তান- এ ভয় থেকেও আমরা নিরাপদ নই। সে বললো, আমাকে তোমরা ‘বাইসান’ সম্পর্কে সংবাদ দাও। আমরা তাকে বললাম, বাইসানের কি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছো? সে বললো, আমি তথাকার খেজুরের বাগান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছি। সেখানের গাছগুলো এখনও ফল দেয়? আমরা বললাম, হ্যাঁ। সে বললো, সে দিন বেশি দূরে নয় যে দিন গাছগুলোতে কোন ফল ধরবে না। অতঃপর সে বললো, আমাকে বুহাইরাতুত্‌ তাবারীয়া সম্পর্কে সংবাদ দাও। আমরা তাকে বললাম, বুহাইরাতুত্‌ তাবারীয়ার কি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছো? সে বললো, আমি জানতে চাই সেখানে কি এখনও পানি আছে? আমরা বললাম, তথায় প্রচুর পানি আছে। সে বললো, অচিরেই তথাকার পানি শেষ হয়ে যাবে। সে পুনরায় বললো, আমাকে যুগার নামক ঝর্ণা সম্পর্কে সংবাদ দাও। আমরা তাকে বললাম, সেখানকার কি সম্পর্কে তুমি জানতে চাও? সে বললো, আমি জানতে চাই সেখানে কি এখনও পানি আছে? লোকেরা কি এখনও সে পানি দিয়ে চাষাবাদ করছে? আমরা বললাম, তথায় প্রচুর পানি রয়েছে। লোকেরা সে পানি দিয়ে চাষাবাদ করছে। সে আবার বললো, আমাকে উম্মীদের নবী সম্পর্কে জানাও। আমরা বললাম, সে মক্কায় আগমণ করে বর্তমানে মদীনায় হিজরত করেছে। সে বললো, আরবরা কি তার সাথে যুদ্ধ করেছে? বললাম, হ্যাঁ। সে বললো, ফলাফল কি হয়েছে? আমরা তাকে সংবাদ দিলাম যে, পার্শ্ববর্তী আরবদের উপর তিনি জয়লাভ করেছেন। ফলে তারা তার আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে। সে বলল, তাই নাকি? আমরা বললাম তাই। সে বললো, তার আনুগত্য করাই তাদের জন্য ভাল। এখন আমার কথা শুনো। আমি হলাম দাজ্জাল। অচিরেই আমাকে বের হওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। আমি বের হয়ে চল্লিশ দিনের ভিতরে পৃথিবীর সমস্ত দেশ ভ্রমণ করবো। তবে মক্কা-মদীনায় প্রবেশ করা আমার জন্য নিষিদ্ধ থাকবে। যখনই আমি মক্কা বা মদীনায় প্রবেশ করতে চাইবো তখনই ফেরেশতাগণ কোষমুক্ত তলোয়ার হাতে নিয়ে আমাকে তাড়া করবে। মক্কা-মদীনার প্রতিটি প্রবেশ পথে ফেরেশতাগণ পাহারা দিবে। হাদিসের বর্ণনাকারী ফাতেমা বিনতে কায়েস বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) হাতের লাঠি দিয়ে মিম্বারে আঘাত করতে করতে বললেন, এটাই মদীনা, এটাই মদীনা, এটাই মদীনা। অর্থাৎ এখানে দাজ্জাল আসতে পারবে না। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষকে লক্ষ্য করে বললেন, তামীম দারীর ঘটনা আমার কাছে খুবই ভাল লেগেছে। তার বর্ণনা আমার বর্ণনার অনুরূপ হয়েছে। বিশেষ করে মক্কা ও মদীনা সম্পর্কে। শুনে রাখো! সে আছে শাম দেশের সাগরে (ভূমধ্য সাগরে) অথবা আরব সাগরে। আর নয়তো সে আছে পূর্ব দিকে। সে আছে পূর্ব দিকে। সে আছে পূর্ব দিকে। এই বলে তিনি পূর্ব দিকে ইঙ্গিত করে দেখালেন। ফাতেমা বিনতে কায়েস বলেন, ‘আমি এই হাদিসটি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর নিকট থেকে মুখস্থ করে রেখেছি’। (সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ফিতান) হযরত ফাতেমা বিনতে কায়স (রাঃ) তামীমে দারীর (রাঃ) ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, তামীমে দারী (রাঃ) বলেছেন, সেই দ্বীপে প্রবেশ করলে আমি সেখানে একটি নারীর সাক্ষাৎ পেলাম যার মাথার চুল এত যে, তা জমিনে হিচড়িয়ে চলে। তামীম জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে? সে বলল, আমি ‘জাসসাসা’ (অর্থাৎ অন্বেষণকারিণী)। অতঃপর সে বলল তুমি প্রসাদের দিকে যাও। সুতরাং আমি সেখানে আসলাম সেখানে লম্বা লম্বা চুল বিশিষ্ট এমন এক ব্যক্তিকে দেখলাম যে, শক্তভঅবে লোহার শিকলে বাঁধা- আসমান জমিনের মাঝখানে লাফালাফি করছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম তুই কে? সে বলল আমি দাজ্জাল।–সুনানে আবূ দাঊদ, হাদিস নং ৪৩২৭ দাজ্জালের নিষিদ্ধ নগরী হযরত আবূ বাকরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মদীনা নগরীতে কখনো দাজ্জালের আশঙ্কা প্রবেশ করবে না। কারণ সেদিন মদীনার সাতটি গেট থাকবে। প্রতিটি গেটে দু’জন করে ফেরেশতা নিযুক্ত থাকবে। (সহীহ বুখারী; হাদীস ৭১২৬) দাজ্জালের ভয়ে মানুষ পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিবে হযরত উম্মে শুরাইক রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি বলতে শুনেছি, দাজ্জালের ভয়ে পলায়ন করে মানুষ পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিবে। উম্মে শুরাইক রাযি. জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর রাসূল! আরব সম্প্রদায় তখন কোথায় থাকবে? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আরব সম্প্রদায় তখন সংখ্যায় অল্প থাকবে। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৯৪৫) দাজ্জাল কখন আবির্ভূত হবে? হযরত ইবনে উমর রাদ্বি. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এমন এক প্রজন্মের আগমন ঘটবে যারা পবিত্র কুরআন পাঠ করবে। তবে তাদের কুরআন পাঠ তাদের কণ্ঠাস্থি অতিক্রম করবে না। এভাবে যখনই এক প্রজন্মের আবির্ভাব হবে তখনই তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। যখনই এক প্রজন্মের আবির্ভাব হবে তখনই তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। এক সময় তাদের বিশাল উপস্থিতিতে দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ; হাদীস ১৭০) কে কোথায় দাজ্জালকে হত্যা করবে? হযরত মাজমা ইবনে জারিয়া রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ঈসা আ. দাজ্জালকে সিরিয়ার লুদ্দ পর্বতের নিকট হত্যা করবে। (সহীহ ইবনে হিব্বান; হাদীস ৬৮১১) হে আল্লাহ দাজ্জালের ফিতনা থেকে আমাদেরকে হেফাজত করুন আমিন। লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী। সাবেক ইমাম ও খতিব কদমতলী মাজার জামে মসজিদ সিলেট।