একজন সাহাবির ব্যাপারে অপবাদ ও তার পরিণতি

প্রকাশিত: ৫:৩৩ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১২, ২০২৪

একজন সাহাবির ব্যাপারে অপবাদ ও তার পরিণতি

একজন সাহাবির ব্যাপারে অপবাদ ও তার পরিণতি

 

হেদায়াতুল্লাহ বিন হাবিব

 

প্রখ্যাত সাহাবি সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)। মহানবী (সা.)-এর খুবই প্রিয় একজন সাহাবি। তার সবচেয়ে মর্যাদার বিষয় তিনি আশারায়ে মুবাশশারা তথা দুনিয়ায়ই জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জন সাহাবির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইসলামের শুরু যুগে ১৭ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।

কেউ কেউ তাকে ইসলামের ১৭তম ব্যক্তি হিসেবেও অভিহিত করেন।

৬৪৬ ও ৬৫১ হিজরি সালে তাকে কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে চীনে পাঠানো হয়। ধারণা করা হয়—নৌ রুটে চীন যাওয়ার পথে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে থেমেছিলেন। এ সময় বাংলা অঞ্চলকে ইসলামের সঙ্গে পরিচয় করানোর ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকাও রেখেছিলেন।

প্রবল ধারণামতে, তিনি ৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের লালমনিরহাটে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছেলেন, যা স্থানীয়ভাবে ‘আবু আক্কাস মসজিদ’ নামে পরিচিত। চীনা মুসলিমদের মতে, চীনের ক্যান্টন বন্দরে তার কবর। তবে আরবদের মতে তার কবর আরবেই অবস্থিত।
এ ছাড়া তিনি ইসলামের ইতিহাসে প্রথম তীর নিক্ষেপকারী ছিলেন।

মদিনায় হিজরতের পরে প্রথম বছরই মহানবী (সা.) ৬০ জন সাহাবির একটি দল আবু সুফিয়ানের একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে পাঠান। এটা ছিল ইসলামের প্রথম সারিয়া। রাগিব নামক স্থানে গিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে তীর ছোড়াছুড়ি হয়। তখন মুসলিম বাহিনী থেকে সর্বপ্রথম তীর নিক্ষেপ করেন সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)।

ইসলামের ইতিহাসে তার একটি চমৎকার ঘটনা উল্লেখ আছে।

তখন উমর (রা.)-এর খিলাফত আমল। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) বসরার শাসক। একবার সেখানকার কিছু দুষ্ট লোক উমর (রা.)-এর কাছে তার নামে কিছু মিথ্যা অভিযোগ করে। এমনকি তার নামাজ আদায়ের ব্যাপারে শৈথিল্যের অভিযোগ পর্যন্ত করার দুঃসাহস দেখায়।

উমর (রা.) সাদ (রা.)-কে ডেকে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। এসব শুনে তিনি খুবই মনঃক্ষুণ্ন হন। প্রথমে তিনি অভিযোগগুলো খণ্ডন করেন। এরপর ইসলামের জন্য বিভিন্ন সময়ে তার ত্যাগ-তিতিক্ষা ও কষ্ট-মুজাহাদার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি ইসলামের প্রথম ব্যক্তি, যে কাফিরদের রক্ত প্রবাহিত করেছে। আমি প্রথম ব্যক্তি, যে আল্লার রাস্তায় তীর নিক্ষেপ করেছে। আমরা মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাহাবিরা এমন অবস্থায় যুদ্ধ করেছি যে গাছের বাকল ও পাতা ছাড়া কিছুই খেতে পেতাম না। এসব খাওয়ার ফলে আমাদের মুখে ঘা হয়ে গিয়েছিল। এমনকি উট ও বকরির মতো মলত্যাগ করতাম। তা সত্ত্বেও বনু আসাদের লোকেরা দ্বিন সম্পর্কে আমাকে অভিযুক্ত করেছে। দ্বিন সম্পর্কে যদি আমি অজ্ঞ হই, তবে তো আমার সব আমল বরবাদ হয়ে গেল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৭২৮; শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস : ৩৭৪)

তিনি আরো বলেন, এদের অভিযোগ—আমি ঠিকমতো নামাজ আদায় করি না। আমি তো মহানবী (সা.)-কে যেভাবে নামাজ পড়তে দেখেছি, ঠিক সেভাবেই নামাজ পড়ি। বিন্দুমাত্র ত্রুটি করি না তাতে।

তখন উমর (রা.) ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও সরেজমিন পরিদর্শনে দুজন ব্যক্তিকে বসরায় পাঠান। তারা সেখানকার প্রতিটি অলিগলি, ঘরবাড়ি ও মসজিদ ঘুরে সত্যতা যাচাই করে। সবাই সাদ (রা.)-এর উচ্চ প্রশংসা ও পক্ষাবলম্বন করে। একজন মাত্র লোক তার বিরুদ্ধে বলে। সে তিনটি অভিযোগ করে—

১. সাদ জীবনের মায়ায় পড়ে জিহাদ থেকে দূরে থাকে।

২. মানুষের মধ্যে সমানভাবে অর্থ-সম্পত্তি বণ্টন করে না।

৩. ন্যায়বিচার করে না।

সাদ (রা.) এই ঘটনা জানতে পেরে দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে তার জন্য তিনটি বদদোয়া করেন—

১. আল্লাহ! এ লোকের জীবন তুমি দীর্ঘ করে দাও!

২. দারিদ্র্যের কষ্ট তাকে ভোগ করাও!

৩. তাকে ফিতনায় নিপতিত করো!

সাদ (রা.)-এর বদদোয়া আল্লাহ কবুল করেছিলেন। বার্ধক্যে তার অবস্থা অনেক শোচনীয় হয়েছিল। ভ্রুর চামড়া চোখের ওপর ঝুলে পড়েছিল। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করত আর যুবতী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করত। কেউ তার এ দুরবস্থার কথা জিজ্ঞেস করলে বলত, আমার গায়ে সাদের বদদোয়া লেগেছে!

(তথ্যসূত্র : আল মাওয়াহিবুল ইলাহিয়্যা, পৃষ্ঠা-৭৩৩)

লেখক : শিক্ষক, প্রবন্ধকার

 

বিডি প্রতিদিন