সিলেট ২০শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৯:৩০ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ২৬, ২০২৫
কোরআনের বয়ানে ‘রংধনু পাহাড়’
আসআদ শাহীন
বিশ্বজগতে বিস্তৃত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নানা নিদর্শনের মধ্যে এমন কিছু স্থান আছে, যা কেবল চোখে দেখার জন্য নয়, বরং অন্তরে উপলব্ধির জন্য। তেমনই এক আশ্চর্য সৃষ্টি চীনের Zhangye Danxia Landform Geological Park-এ অবস্থিত রংধনু পাহাড় বা Rainbow Mountains, যা নানা রঙের স্তরে স্তরে গঠিত এক অসামান্য সৌন্দর্য। এই পাহাড় দেখে মনে হয় যেন মহান কোনো শিল্পী রংতুলি দিয়ে সযত্নে এঁকেছেন। তবে এই রঙিন শিলার ঢেউ শুধু সৌন্দর্য নয়, ঈমানদারদের কাছে এটি এক পরম সত্যের নিদর্শন, যাকে আমরা কোরআনের আলোকে আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি।
রেইনবো মাউন্টেনের ভূতাত্ত্বিক পরিচয়
চীনের গানসু প্রদেশে অবস্থিত এই পাহাড়ি অঞ্চলটি মূলত ‘Danxia Landform’ নামে পরিচিত। ভূবিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী, প্রায় ২৪ মিলিয়ন বছর ধরে গঠিত এই স্তরবিন্যাস মূলত লাল বালুকা পাথর এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থের জারণ বিক্রিয়ায় গঠিত হয়েছে। তবে রঙিন রেখার সুষম বিন্যাস ও বৈচিত্র্য দেখে মনে হয় যেন এটি একটি কল্পনার জগৎ। লাল, কমলা, হলুদ, নীল, সবুজ—সব রঙের নিখুঁত ভারসাম্য যেন পাহাড়ের প্রতিটি বাঁকে এক নতুন কবিতা রচনা করে।
যে দিকে চোখ যায় সে দিকেই রং। এই পাহাড় আসমানি, কমলা, লাল, হলুদ, সবুজ—সব রঙে রাঙা। প্রকৃতি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সুবিশাল ক্যানভাসে তুলির টানে সৃষ্টি করেছে এই রংমহল।
ভূবিজ্ঞানীরা বলেন, টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে শুষ্ক পর্বতগাত্রে এমন রংধনুর সাত রং ফুটে উঠেছে।
টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে ভূগর্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছিল শিলাস্তর। শিলাস্তরে ছিল প্রচুর খনিজ পদার্থ, রঙিন সিলিকাসহ নানা উপাদান। বহু বছর ধরে ঋতু পরিবর্তন, ঝড়-বৃষ্টি, তুষারপাত এবং নানা রকম রাসায়নিক বিক্রিয়ায় রূপ পরিবর্তন করতে করতে তৈরি হয়েছে বর্তমানের রেইনবো মাউন্টেন। কিন্তু এই নিখুঁত শৈল্পিক বিন্যাস কি কেবল প্রকৃতির সপ্তম আশ্চর্যের খেলা?
আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে প্রকৃতি
পবিত্র কোরআন বারবার আমাদের চোখ ফেরাতে বলেন প্রকৃতির দিকে, কারণ The beauty of nature আল্লাহর নিদর্শন। কোরআনে বলা হয়েছে : ‘তুমি কি দেখো না যে আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তা দ্বারা বিভিন্ন রঙের ফলমূল উৎপন্ন করেন? আর পাহাড়গুলোতেও আছে সাদা, লাল এবং নানা রঙের রেখাযুক্ত অংশ ও নিকষ কালো।’
(সুরা : ফাতির, আয়াত : ২৭)
প্রখ্যাত মুফাসসির শায়খ আবদুর রহমান আস-সাদি (রহ.) বলেন, আল্লাহ তাআলা যেভাবে পৃথিবীকে স্থিতিশীল রাখার জন্য পর্বতমালা সৃষ্টি করেছেন, সেভাবেই তিনি সেই পর্বতগুলোকেও রূপ দিয়েছেন বৈচিত্র্যময় রঙের, সৌন্দর্য ও মাধুর্যের এক বিস্ময়কর আবরণে।
আয়াতে ব্যবহৃত ‘জুদাদ’ শব্দটির অর্থ পর্বতের বুকে আঁকা রেখা বা শিরা। তিনি বলেন, একটি পর্বতের মধ্যেই দেখা যায় সাদা শিরা, লালচে বা পিঙ্গল রেখা এবং গভীর কালো রেখা—যাকে বলা হয়েছে ‘গারাবিবু সুদ’, যার অর্থ অত্যন্ত গাঢ় কালো, যেন কাকের পালকের মতো নিখাদ কালো। (তাফসিরে সাদি, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৬৮৮)
এই আয়াতটি চীনের রংধনু পাহাড়কে স্মরণ করিয়ে দেয়। এখানে বলা হয়েছে—‘নানা রঙের রেখাযুক্ত পাহাড়’, যা সুনির্দিষ্টভাবে Danxia-এর বর্ণনা মনে করায়। প্রকৃতির এই রঙিন বিন্যাস কেবল চাক্ষুষ আনন্দের বিষয় নয়, এটি আল্লাহর কুদরতের প্রতীক।
রংধনু পাহাড় ও ‘তাফসিরুল আয়াত’
কোরআনে একটি শব্দ বারবার ব্যবহৃত হয়েছে—তাফসিরুল আয়াত অর্থাৎ নিদর্শনের বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা ও পুনরাবৃত্তি। এটি প্রকৃতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যখন আমরা রংধনু পাহাড়ের মতো সৌন্দর্য দেখি, তখন তা আমাদের চিন্তা-ভাবনায় নতুন মাত্রা যোগ করে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি পৃথিবীতে নানা রঙের বস্তু সৃষ্টি করেছেন। এতে আছে নিদর্শন চিন্তাশীল জাতির জন্য।’ (সুরা : আন-নাহল, আয়াত : ১৩)
চীনের রংধনু পাহাড় যেন এই আয়াতের জীবন্ত ব্যাখ্যা। এখানে রঙের যে বৈচিত্র্য দেখা যায়, তা মানুষের দৃষ্টি ও হৃদয়—উভয়কে আকৃষ্ট করে এবং বিশ্বাসী হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে স্রষ্টার প্রশংসা।
চিত্রশৈলী ও কোরআনের অলংকার
কোরআনের ভাষা অলংকারপূর্ণ, চিত্রাত্মক ও ভাবনাবোধক। যখন আমরা পাহাড়ের রঙিন রূপ দেখি, তখন মনে পড়ে কোরআনের সেই উপমা যেখানে মেঘ, পাহাড়, আলো-আঁধারির সমন্বয়ে সৃষ্টিশীলতা ফুটে ওঠে; কোরআনে বলা হয়েছে : ‘আল্লাহর সৃষ্টিকে দেখো! কিভাবে তিনি বিভিন্ন রঙের সৃষ্টি করেছেন!’
(সুরা : আন-নাহল, আয়াত : ১৬)
Zhangye Danxia যেন এই আয়াতের চিত্ররূপ। যেমনভাবে কোরআন একটি চিত্রকল্প সৃষ্টি করে, তেমনি এই পাহাড় তার রং ও রেখায় আমাদের সামনে একটি জীবন্ত আলোকচিত্র তুলে ধরে।
রংধনু পাহাড় ও মানুষের হৃদয়ের সংলাপ
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শুধু বাহ্যিক দর্শনের বিষয় নয়, এটি মানুষের হৃদয়ের গভীরে স্পর্শ করে। কোরআনে বলা হয়েছে : ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের পরিবর্তনে বোধশক্তিসম্পন্নদের জন্য নিদর্শন আছে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৯০)
যিনি রংধনু পাহাড়ের মতো নিখুঁত নকশা সৃষ্টি করতে পারেন, তিনি নিঃসন্দেহে একজন সুবিশাল পরিকল্পনাকারী। এখানে কেবল শৈল্পিকতা নয়, বরং রয়েছে গণিত, রসায়ন ও সময়ের নিখুঁত সমন্বয়। এটি কেবল সৌন্দর্য নয়, এটি একটি মহাজাগতিক সিম্ফনি।
প্রকৃতির রং ও আত্মার জাগরণ
রং মানুষের মনোজগতে বিশেষ প্রভাব ফেলে। রংধনু পাহাড়ের প্রতিটি শিলা যেন একটি বার্তা বহন করে। কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ রং দিয়েছেন, যেমন রং তিনিই দিতে পারেন।’
(সুরা : আল-বাকারাহ, আয়াত : ১৩৮)
এই আয়াতে সিবগাতুল্লাহ বা ‘আল্লাহর রং’ কথাটি এসেছে। চীনের এই পাহাড় সেই রঙেরই এক নিদর্শন, যা শুধু চাক্ষুষ রূপ নয়, আধ্যাত্মিক উপলব্ধির একটি উৎস।
রঙিন পাহাড়, রঙিন জীবন ও ঈমানের প্রতিচ্ছবি
চীনের রংধনু পাহাড় প্রকৃতির এক বিস্ময়, কিন্তু একজন মুমিনের জন্য এটি তার ঈমানের শক্তি পুনর্জাগরণের উপলক্ষ। এটি প্রমাণ করে যে পৃথিবীতে এমন কোনো কিছুর সৃষ্টি হয়নি, যা উদ্দেশ্যহীন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : ‘আমি আকাশ ও পৃথিবী এবং তাদের মধ্যে যা কিছু আছে তা ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি।’
(সুরা : আদ-দুখান, আয়াত : ৩৮)
এখানে এই পাহাড় যেন চিৎকার করে বলে—‘আমার পেছনে এক মহান পরিকল্পক আছেন।’ এবং সেই পরিকল্পকের প্রতি আমাদের ঈমান আরো গভীর হয়, যখন আমরা কোরআনের আয়াত এবং পাহাড়ের রংকে মিলিয়ে দেখি।
আল্লাহর নিপুণ শিল্পকর্মের বহিঃপ্রকাশ
রেইনবো মাউন্টেন—এ এক চিত্রকরের তুলির ছোঁয়া নয়, বরং আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় গঠিত প্রাকৃতিক শিল্পকর্ম। যুগে যুগে এই বৈচিত্র্য নজরে এসেছে ভূবিজ্ঞানীদের, পর্যটকদের, এমনকি সাধারণ পথিকেরও। কিন্তু আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে এই বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিত দিয়েছেন হাজার বছর আগেই, যখন মানুষের জ্ঞান এই প্রাকৃতিক রহস্যের কেবল প্রান্ত স্পর্শ করত।
উপরোক্ত আয়াত আমাদের দৃষ্টি দেয় প্রকৃতির গভীরে এবং নির্দেশ করে এক মহান শিল্পীর দিকে, যিনি তাঁর সৃষ্টিকে শুধু প্রয়োজনের জন্যই গড়েননি, বরং দিয়েছেন সৌন্দর্য, শৈল্পিকতা ও ভাবগম্ভীরতা। প্রতিটি পাহাড় যেন এক একটি মৌন কবিতা—সাদা রেখা তার পবিত্রতা, লাল তার আবেগ, আর গাঢ় কালো তার গভীরতা ও গাম্ভীর্য প্রকাশ করে।
এই রঙিন পর্বতগুলো শুধু প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়, বরং তারা আল্লাহর কুদরত ও জ্ঞানের সাক্ষ্য বহন করে। তারা নীরবে ঘোষণা করে : ‘তোমাদের স্রষ্টা কেবল ক্ষমতাবানই নন, তিনি অপার সৌন্দর্যেরও অধিকারী।’
অতএব, উপরোক্ত আয়াত কেবল ভৌগোলিক সত্যের বর্ণনা নয়, এটি এক আত্মিক আহবান—মানুষ যেন প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে আল্লাহর অস্তিত্ব, জ্ঞান, শক্তি ও সৌন্দর্য অনুধাবন করে। সত্যিই সৃষ্টির মধ্যে ছড়িয়ে আছে স্রষ্টার নিপুণতা। চোখের সামনে দৃশ্যমান প্রতিটি পাহাড়ের বুকে আঁকা রঙিন রেখাগুলো যেন তাঁর মহানত্বের মৌন সাক্ষী।
বিডি-প্রতিদিন
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ নাজমুল কবীর পাভেল
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : জুমা কবীর মিম
সহ সম্পাদকঃ আরিফ মাহবুব
নির্বাহী সম্পাদকঃ ধ্রুব জ্যোতি দে
ব্যবস্থাপনা সম্পাদকঃ মাহমুদা আক্তার বিউটি
আইটি সম্পাদক : মাসুম আহমদ
উপদেষ্টা সম্পাদক : এ্যাডভোকেট জাহানারা বেগম
ইমেইল: sylnewsbd@gmail.com, pavel.syl@gmail.com
ফেইসবুক পেইজ : Syl News BD
মোবাইলঃ 01712-540420
শ্রীহট্ট মিডিয়া লিমিটেডের একটি প্রতিষ্ঠান।
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি