সিলেট ১১ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৭শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১১:৪৪ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ৪, ২০২৫
সিলেটের সাংবাদিকের সাথে ‘হক ভাইয়ের’ ছিল সুসম্পর্ক
এম এ হক : আদর্শিক রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম :
দেখতে দেখতে হক ভাইয়ের মৃত্যুর ৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল। ২০২০ সালের এই দিনে (৩ জুলাই) প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের কাছে হার মানেন সিলেট বিএনপির অভিভাবকতুল্য নেতা মোহাম্মদ আব্দুল হক (এম এ হক)। তিনি ছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক।
মৃত্যু মানুষের অনিবার্য পরিণতি। প্রত্যেক মানুষকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যুকে উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই। অনেকটা পরিণত বয়সেই হক ভাই বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু, তার রেখে যাওয়া অমলিন স্মৃতি আজো আমার মতো অনেককে কাঁদায়।
হক ভাইয়ের সাথে ছিল আমার অনেকটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক। সিলেটের সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক, একজন সাদা মনের মানুষ হিসেবে যিনি পরিচিত, দৈনিক ইনকিলাব ও আমাদের দেশ-এর সাবেক ব্যুরো চিফ জনাব এটিএম হায়দারের মাধ্যমে মূলত তার সাথে প্রথম পরিচয়। পত্রিকার কাজে হায়দার ভাই অনেক সময় তার কাছে আমাকে নিয়ে যেতেন। সিলেটের ডাক-এর নিউজ রুমে নির্বাহী সম্পাদক শ্রদ্ধেয় সাত্তার ভাই(বর্তমানে যুক্তরাজ্য প্রবাসী) এবং বার্তা সম্পাদক শ্রদ্ধেয় এনামুল হক জুবের ভাই(বর্তমানে সিলেটের ডাক-এর প্রধান বার্তা সম্পাদক) ও প্রায়শ হক ভাইয়ের গল্প করতেন। এরপর পরিচয় রূপ নেয় সখ্যতায়। সিলেটের সাংবাদিকের সাথে ‘হক ভাইয়ের’ ছিল সুসম্পর্ক। হায়দার ভাই সাংবাদিকতা থেকে অবসর নেবার পর আমি এবং খালেদ ভাই(বর্তমানে আমার দেশ এর ব্যুরো চিফ ও সিলেট প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি)-কে খুব বেশী স্নেহ করতেন। একটু অবসর সময় পেলেই আমি ও খালেদ ভাইকে তার মেন্দিবাগস্থ তার ব্যবসায়িক অফিসে যাবার আমন্ত্রণ জানাতেন। তার কাছে যেতে হতো ২/৩ ঘন্টা সময় হাতে নিয়ে। গল্প-গুজব চলতো দীর্ঘক্ষণ । অনেক রাজনৈতিক নেতাও তাতে শামিল হতেন। রাজনীতি, সমাজ নীতি থেকে শুরু সবকিছুই উঠে আসতো আমাদের আলোচনায়। তিনি আমাদের দুজনকে এতোটাই স্নেহ করতেন যে, দুপুরের সময় হয়ে গেলে অনেকদিন বাসায়ও নিয়ে যেতেন কিংবা কোন হোটেলে নিয়ে দুপুরের লাঞ্চ (খাবার) করতেন।
১৯৫৪ সালের ১ জুলাই সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার দেওয়ানবাজারের কুলুমাগ্রামে জন্মগ্রহণকারী এম এ হক ছিলেন একজন দ্বীনদ্বার মানুষ। প্রতি বছর রমজানে তিনি পবিত্র উমরাহ পালনে চলে যেতেন সৌদি আরবে। রমজানের শেষ ১০ দিন আল্লাহর ঘর (বায়তুল্লাহ শরীফ) সময় কাটাতেন। ২০১৮ সালে সৌদি আরবে ওমরাহ পালনে গিয়ে সাক্ষাত হয় তার সাথে। তখন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন কারাবন্দী। একদিন যোহরের নামাজের পর দেখি, হক ভাই তার রুমে মোনাজাতরত। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার জন্য অঝোরধারায় কাঁদছেন। তার মোনাজাতের সারমর্ম ছিল এরুপ-‘আল্লাহ বেগম খালেদা জিয়া আজ বড়ই অসহায়, তার প্রতি আল্লাহ বিশেষ রহম নসিব করুন।’
প্রতিদিন সকালে ফজরের নামাজ পড়ে পবিত্র কুরআন শরীফ তেলাওয়াতের আমল ছিল হক ভাইয়ের। আলেম-উলামার সাথেও ছিল তার বিশেষ সম্পর্ক। প্রতিদিন সকালে তার সাক্ষাতলাভের জন্য বিপুল সংখ্যক আলেম-উলামা তার যতরপুরের বাসায় আসতেন। তাদেরকে ব্যক্তিগত সহায়তার পাশাপাশি মসজিদ-মাদ্রাসায় তিনি অকাতরে দান করতেন।
বিএনপি এবং বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি ছিল হক ভাইয়ের অগাধ ভালোবাসা ও বিশ্বাস। ছিলেন ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী। বিএনপির সঙ্গে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সংগঠনটির জড়িত তিনি। ১৯৯৩ সালে তিনি বিএনপির সিলেট জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। টানা এক যুগ তিনি সভাপতি হিসেবে সিলেট বিএনপিকে নেতৃত্ব দেন। ১৯৯৬ সালে বিএনপির সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ওই বছর তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। ২০০৩ ও ২০০৮ সালে সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে লড়েন তিনি। পরবর্তীতে ২০১২ সিলেট মহানগর বিএনপির কোন্দল নিরসনে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তাকে দায়িত্ব দেন। সেসময় মহানগর বিএনপির সভাপতির দায়িত্বও বর্তায় তার কাঁধে। আন্দোলন সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার জন্য দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার গুরুত্বপূর্ণ পদে তাকে রাখা হয়েছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট ক্ষমতাসীন ছিল। সিলেটে চার দলীয় জোট সুসংগঠিত রাখতে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। এছাড়া, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) বিভিন্ন হল ও ভবনের নামকরণবিরোধী আন্দোলনেও তার ভূমিকা ছিল সক্রিয়। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি চ্যারিট সংগঠন হক ফাউন্ডেশনেরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
বিএনপি করার কারণে তাকে কতই না নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। ২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর সিলেট নগরীর রেজিস্ট্রি মাঠে পুলিশের লাঠিপেটায় রক্তাক্ত হন এম এ হক। তার সাথে সাবেক সংসদ সদস্য দিলদার হোসেন সেলিম ও জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আব্দুল গাফ্ফারসহ দলের অনেক কর্মীকে লাঠিপেটা করা হয়। এক পর্যায়ে দলের সিনিয়র এই তিন নেতাকে হাতকড়া পরিয়ে ও রশি দিয়ে বেধে গাড়িতে উঠায় পুলিশ। এই সংবাদ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, এম এ হকসহ এই তিনজন নেতাই আজ পরপারে।
২০২০ সালের মার্চে করোনা ভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর হক ভাই নিজেকে অনেকটাই সামলে নেন। নিজের পেট্রোল পাম্প ছাড়া আর কোথাও বেশী বের হতেন না। এরপর জুনের শেষের দিকে তিনি প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। ভর্তি হন নর্থ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে)। সেখানে কয়েকদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ৩ জুলাই সকাল ১০টায় চিরবিদায় নেন সবার প্রিয় হক ভাই। সেদিন সকালে হক ভাইয়ের একমাত্র পুত্র, বিলেত থেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যারিস্টার রিয়াশাদ আজিম হক আদনান মুঠোফোনে তার বাবার মৃত্যু সংবাদটি নিশ্চিত করেন। ওইদিন আছরের নামাজের পর হযরত মানিকপীর (র.) কবরস্থানে হক ভাইয়ের প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তখন মানুষের কাছে ছিল কোভিড মূর্তিমান আতংকের নাম ; কিন্তু, হক ভাইয়ের জানাজায় ছিল মানুষের বিপুল উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছি। এ থেকে প্রমাণিত হয় ‘হক ভাই’ মানুষের কাছে কত জনপ্রিয় ছিলেন। পরবর্তীতে বালাগঞ্জে কুলুমায় গ্রামের বাড়িতে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
হক ভাই আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু, তার অবর্তমানে সিলেটে বিএনপি’র রাজনীতিতে তার যে শূণ্যতা-তা সকলেই অকপটে স্বীকার করবেন। আল্লাহ প্রিয় হক ভাইকে জান্নাবাসী করুন। আমিন।
মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম ॥ চিফ রিপোর্টার, দৈনিক সিলেটের ডাক, সাধারণ সম্পাদক, সিলেট প্রেসক্লাব।
সেৌজনে্য :
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ নাজমুল কবীর পাভেল
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : জুমা কবীর মিম
সহ সম্পাদকঃ আরিফ মাহবুব
ব্যবস্থাপনা সম্পাদকঃ আম্বিয়া পাভেল
আইটি সম্পাদক : মাসুম আহমদ
ইমেইল: sylnewsbd@gmail.com, pavel.syl@gmail.com
ফেইসবুক পেইজ : Syl News BD
মোবাইলঃ 01712-540420
শ্রীহট্ট মিডিয়া লিমিটেডের একটি প্রতিষ্ঠান।
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি