লতিফুর রহমানের জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার গল্প

প্রকাশিত: ৮:২২ অপরাহ্ণ, জুলাই ১, ২০২০

লতিফুর রহমানের জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার গল্প

অনলাইন ডেস্ক :;

ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী লতিফুর রহমান (৭৫) বুধবার সকালে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে নিজস্ব বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি দ্য ডেইলি স্টারের পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান মিডিয়াওয়ার্ল্ড ও প্রথম আলোর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান মিডিয়াস্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন।

লতিফুর রহমানের জন্ম জলপাইগুড়িতেই, ১৯৪৫ সালের ২৮ আগস্ট। দুই বোনের পর তার জন্ম। পরে আরও এক বোন ও এক ভাই আছেন। ছোটবেলায় পড়তেন সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলে। সেখান থেকে চলে যান হলিক্রস স্কুলে। সে সময় হলিক্রসে ছেলেরাও পড়ত। ১৯৫৬ সালে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের শিলংয়ে। সেন্ট এডমন্ডস স্কুলে ভর্তি হলেন ক্লাস থ্রিতে। সেখান থেকে কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে।

১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কারণে ঢাকায় ফিরে এলেন লতিফুর রহমান। এসে শুরু করেন পাটের ব্যবসায়। বাবা তখন চাঁদপুরে গড়ে তুলেছেন ডব্লিউ রহমান জুট মিল।

১৯৬৩ সালে কাজ শুরু হলেও উৎপাদন শুরু হলো ১৯৬৬ সালে। সে বছরই তিনি ট্রেইনি হিসেবে কাজ শুরু করেন। দেড় বছর কাজ শেখার পর একজন নির্বাহী হিসেবে যোগ দেন। প্রশাসনের দিকটা তিনি দেখতেন। এভাবে কাজ করলেন ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। ১৯৭২ সালে মাত্র পাঁচজনকে নিয়ে ট্রান্সকম গ্রুপের যাত্রা করেন লতিফুর রহমান।

১৭ বছর বয়সে লতিফুর রহমানের একটা নিজস্ব গাড়ি ছিল। ছোট একটা ফিয়াট। তাদের পাটের বড় ব্যবসা ছিল। বাঙালির তৈরি করা প্রথম পাটকলটি ছিল তাদের। আর ছিল চা-বাগান। গুলশানে লতিফুরের নিজের বাড়ি হয় সেই ১৯৭০ সালেই।’

জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার গল্প

লতিফুর রহমান ২০১২ সালে পেয়েছেন বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড। এরপর ওই বছর প্রথম আলো শনিবারের সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র ছুটির দিনে শওকত হোসেন লিখেছিলেন‘ব্যবসায় স্বীকৃতি’ শিরোনামে লতিফুর রহমানের জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার গল্প-

১৯৭৪ সাল। তখন লতিফুর রহমানের হাতে নগদ টাকা ছিল না। কিন্তু চা কিনতে হলে টাকা লাগবে। নেদারল্যান্ডসের রটারডাম-ভিত্তিক ভ্যান রিস তখন বিশ্বে চা সরবরাহকারীদের মধ্যে সেরা কোম্পানি। নানা দেশ থেকে চা কিনে তারা সরবরাহ করে। বাংলাদেশে তাদের হয়ে চা কেনার কাজটি লতিফুর রহমান পেলেন। তাদের পাটকলের একটা হিসাব ছিল উত্তরা ব্যাংকের সঙ্গে। ব্যাংকের কাছে তিনি চেয়েছিলেন ৫০ লাখ টাকার ঋণ। তৎকালীন উত্তরা ব্যাংকের মুখ্য ব্যবস্থাপক মেজবাহ উদ্দীন সেই ঋণের ব্যবস্থা করে দিলেন, কিন্তু ঋণের মার্জিন ২০ শতাংশ। এর অর্থ হলো লতিফুর রহমানের নিজের থাকতে হবে ১০ লাখ টাকা। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য ঋণের প্রস্তাবটি গেল ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) কাছে। উত্তরা ব্যাংকের এমডি তখন মুশফিকুর সালেহীন।

তিনি আগে থেকেই লতিফুর রহমানের বাবাকে চিনতেন। তার সঙ্গে কথোপকথনের এক পর্যায়ে উঠল মার্জিনের প্রসঙ্গটি। সালেহীন সাহেব লতিফুর রহমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে, মার্জিন ১০ শতাংশ থাকুক।

প্রতিবেদনে লতিফুর রহমানের ভাষ্য, ‘আমার তো তখন চরম আর্থিক সংকট। তাই আমি বললাম, আমার কাছে টাকা নেই। আমি ১০ শতাংশ মার্জিন দিতে পারব না। তিনি এবার বললেন, ঠিক আছে, ৫ শতাংশ দিন। আমি এবার মরিয়া হয়েই বললাম, আমার কাছে কোনো টাকাই নেই। তিনি বললেন, আচ্ছা, কোনো মার্জিনই লাগবে না।

‘সেই ৫০ লাখ টাকা নিয়ে আমি চা কেনা শুরু করলাম। চট্টগ্রামে একটা অফিস নিলাম। শুরু হলো নতুন ব্যবসা। এর ঠিক ১৪ বছর পর মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) একটি বড় প্রতিনিধিদল গেল চীন, জাপান ও কোরিয়াসহ কয়েকটি দেশে। সেখানে সালেহীন সাহেবও ছিলেন। সিউল এয়ারপোর্টে আমি তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, আজ আমার যা কিছু অর্জন, তা আপনার জন্যই। কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, সেদিন কেন আপনি আমাকে শূন্য মার্জিনে ঋণ দিয়েছিলেন। এভাবে তো ঋণ দেওয়া হয় না। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, আমার বাবাকে তিনি চিনতেন। তাঁর সুনাম, ব্যাংক লেনদেনে স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার কথা জানতেন। সেই বাবার ছেলে বলেই বিশেষ সুযোগটি দিয়েছিলেন। তারপর সালেহীন সাহেব আরও একটি কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ১৪ বছর হয়ে গেল। আপনার প্রতি যে আস্থা রেখেছিলাম, তার প্রতিদান দিয়েছেন। এখন যদি আপনার ছেলে আমার কাছে আসে, আমি তাকেও এভাবে ঋণ দেব।’

লতিফুর রহমান জানিয়েছিলেন, সেই যে মুশফিকুর সালেহীন বিনা শর্তে ৫০ লাখ টাকার ঋণের ব্যবস্থা করেছিলেন, সেটিই তাঁর জীবনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’। জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল সেই এক ঘটনায়। অথচ এভাবে ঋণ নেওয়ার কথা ছিল না।