শিশুদের করোনাভাইরাস ও কাওয়াসাকি রোগ

প্রকাশিত: ৫:৩২ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৮, ২০২০

শিশুদের করোনাভাইরাস ও কাওয়াসাকি রোগ

ডা. মোহাম্মাদ আরিফ হোসেন, জাপানের চিকিৎসা বিজ্ঞানী :;
অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম শিশুদের কাওয়াসাকি রোগ (Kawasaki Disease) নিয়ে লিখব, বিশেষ করে করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ এ আক্রান্তের ফলে সারা বিশ্বে শিশুরা যেভাবে কাওয়াসাকি রোগের লক্ষণ প্রকাশ করছে, পৃথিবীর বড় বড় শিশু বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের চক্ষু চড়কগাছ।

আর তাই আজ আমি আপনাদের সঙ্গে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেয়ার করতে চাই, কেননা আমাদের শিশুরাই আমাদের জীবনের বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন। প্রথমেই বলে নিই, আজকের এই লেখাটি তৈরি করা হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম তিনটি বিখ্যাত জার্নাল “The Lancet”, “Nature Reviews” এবং “The New England Journal” এ সদ্য প্রকাশিত আর্টিকেলকে অবলম্বন করে। আমি লেখার শেষাংশে লিংকগুলো যোগ করে দিব, যারা বিস্তারিত জানতে চান, তাঁরা সেখান থেকে উপকৃত হতে পারবেন।

কাওয়াসাকি রোগ কী?

কাওয়াসাকি রোগ হল অনেকগুলো লক্ষণের সমষ্টি যেখানে জ্বর হল প্রাথমিক লক্ষণ এবং মূলত ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদেরকে এই রোগটি প্রভাবিত করে। এই অসুখে সারা শরীর জুড়ে রক্তনালীগুলি ফুলে উঠে যেটাকে বলা হয় Vasculitis। যার ফলে শরীরে উচ্চ তাপমাত্রা (১০২-১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) দেখা দেয়, যা পাঁচ দিনের মত স্থায়ী হয় এবং এটি সাধারণত প্যারাসিটামল বা অন্যান্য জ্বরের ওষুধ সেবনে ও কমে না।

কাওয়াসাকি রোগের লক্ষণ

অন্যান্য সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে ঘাড়ের দুই দিকে লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া, যৌনাঙ্গের চারিদিকে ফুসকুড়ি, চোখ-ঠোঁট বা জিহ্বা গাঢ় লাল হওয়া এমনকি পায়ের পাতাগুলিও রক্ত বর্ণ ধারণ করা। কোন কোন ক্ষেত্রে বাচ্চার করোনারি ধমনী (Coronary Artery) তে Aneurysm (ফুলে ওঠা) হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে এই রোগকে স্কারলেট জ্বর (Scarlet Fever) বা রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস (Juvenile Rheumatoid Arthritis) মনে করে ভুল রোগ নির্ণয় করা হয়। তবে আশার কথা হল, কাওয়াসাকি রোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে ভাল হয়ে যায়।

কাওয়াসাকি রোগের কারণ কী?

কাওয়াসাকি রোগের সুনির্দিষ্ট কারণটি এখনও অজানা। তবে ধারণা করা হয়, শিশুদের মধ্যে কোন জীবাণুর সংক্রমণ ঘটলে তাকে মুকাবিলা করার জন্য শরীরের যে প্রতিরোধ ব্যবস্থা আছে কোন কোন ক্ষেত্রে তা অত্যধিক সক্রিয় হয়ে ওঠে। যার ফলশ্রুতিতে জীবাণু ধ্বংস করার পাশাপাশি নিজের শরীরেই Vasculitis তৈরি করে। তবে গবেষণা জেনেটিক সম্পৃক্ততার কথা ও উল্লেখ করছে। তবে এটি ছোঁয়াচে কোন অসুখ নয়।

কাওয়াসাকি রোগের সঙ্গে করোনাভাইরাসের সম্পর্ক কী?

আমরা সাধারণভাবে জানি কভিড-১৯ মানুষের শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসতন্ত্রকে (Respiratoy System) আক্রমণ করে এবং রোগীর তীব্র শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য সহযোগী লক্ষণ প্রকাশ করে। কিন্তু এই মরণ ভাইরাস শুধু শ্বাসতন্ত্রই আক্রমণই নয়, এটি শরীরের Immune সিস্টেমকে ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করে। এই ভাইরাসের মুকাবিলায় শরীরের Macrophage-Phagocytic সিস্টেম এতটা সক্রিয় হয় যে কাওয়াসাকি রোগের মতো সকল লক্ষণ প্রকাশ হতে দেখা যায়।

গবেষণাপত্র কী বলে?

ড. লুসিও ভারগনি ও তার টিম “The Lancet” জার্নালে গত মে মাসের ১৩ তারিখে প্রকাশ করেছে ইতালির বারগামো প্রদেশে গত পাঁচ বছরের তুলনায় শিশুদের মধ্যে কাওয়াসাকি রোগের পরিমাণ ৩০ গুণ বেড়েছে যাদের সবাই কভিড-১৯ পজিটিভ। আর শিশুদের মধ্যে Macrophage-Phagocytic সিস্টেমের সক্রিয়তার যথেষ্ট প্রমাণ ও মিলেছে। আর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ও কাওয়াসাকি রোগের একই চিকিৎসাতে উৎসাহ ব্যঞ্জক সাফল্য পাওয়া গিয়েছে।

ড. ক্যারোলিন গ্যালেওতি ও তাঁর টিম “Nature Reviews” জার্নালে এবং ড. রানডলফ ফেলদস্তেইন ও তাঁর টিম “The New England Journal” জার্নালে এই জুনে প্রকাশ করেছে যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কভিড-১৯ পজিটিভ শিশুদের মধ্যে অটোইমিউন মাল্টি-সিস্টেম ইনফ্লামেটারি সিনড্রোম (Auto-immune Multisystem Inflammatory Syndrome) ব্যাপক হারে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর কাওয়াসাকি রোগ তাদের মধ্যকারই একটি ব্যাধি।

এখানে উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্রে যে ১৮৬ জন শিশুর মধ্যে অটোইমিউন মাল্টি-সিস্টেম ইনফ্লামেটারি সিনড্রোম পাওয়া গেছে (গড় বয়স ৮.৩ বছর) তার মধ্যে ৭৪ জনেরই (৪০%) কাওয়াসাকি রোগের লক্ষণ ছিল এবং সবারই ৪-৫ দিন জ্বর ছিল। আরও উল্লেখ্য যে, তারা প্রায় সবাই কাওয়াসাকি রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রে উন্নতি সাধন করেছে।

কাওয়াসাকি রোগের চিকিৎসা

কাওয়াসাকি রোগের একেবারে প্রাথমিক চিকিৎসা হল অ্যাসপিরিন (Aspirin) ও ইমিউনোগ্লোবিউলিন (Immunoglobulin)। তবে ড. রানডলফ ও তাঁর টিম ইমিউনোগ্লোবিউলিনের পাশাপাশি গ্লুকো-করটিকয়েড, ইন্টারলিউকিন- ৬ ইনহিবিটর, ইন্টারলিউকিন- ১Ra ইনহিবিটর প্রয়োগ করে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন। তবে অবশ্যই রোগের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেলে কোনভাবেই ঘরে বসে চিকিৎসা দেয়া যাবে না, অতি দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে, হাসপাতালে ভর্তি থেকে ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করতে হবে। অত্যন্ত আশার বিষয় হল, কভিড-১৯ ছোঁয়াচে হলেও কাওয়াসাকি রোগ ছোঁয়াচে নয় এবং অসুখ ঠিকমত রোগ ধরা পড়লে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরতে পারবেন।

লিংকগুলো নিম্নে বর্ণিত হল
https://www.thelancet.com/journals/lancet/article/PIIS0140-6736(20)31103-X/fulltext
https://www.nature.com/articles/s41584-020-0448-7
https://www.nejm.org/doi/pdf/10.1056/NEJMoa2021680?articleTools=true

লেখক: ডা. মোহাম্মাদ আরিফ হোসেন

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী, টোকিও, জাপান
সুত্র : যুগান্তর

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ