পংকজ দা’র ৫০০ টাকা !

প্রকাশিত: ৯:৫৯ অপরাহ্ণ, জুন ১০, ২০২০

পংকজ দা’র ৫০০ টাকা !

শাহরিয়ার বিপ্লব :: পংকজ দা’র মৃত্যু সংবাদ পেয়ে উনাকে শেষ বিদায় দিতে সাচনা যাবো। কিন্তু বেশী রাত হওয়ায় আর যেতে পারিনি। তার উপর করোনার মনোস্তাত্তিক চাপ তো আছেই।

পরের দিন সন্ধ্যায় পংকজ দা’র বাসায় যাচ্ছি। পথিমধ্যে দুই/এক জন মানা করলেন। করোনায় নাকি মারা গেছেন। বাসায় যাওয়া যাবে না।

একটু খটকায় পড়লাম। পরে ভাবলাম করোনা হলেও তো তিনঘণ্টা পরে জীবাণু থাকে না। আর আমি যাচ্ছি শ্মশান ঘাটে পংকজ’দাকে দাহ করার একদিন পরে।

উনার ছেলের বিয়েতে যেতে পারিনি। বিয়ের পরেও কয়েকটি দাওয়াত মিস করেছি। অসুস্থ হয়েছেন। করোনার প্রকোপে দেখতে যেতে পারিনি।

এখন তিনি নাই। আমি গেলে কি হবে? তাঁর আত্মা কি দেখবে? না দেখুক। বৌদি, প্রিয়াঙ্কা বা ছেলেটাকে দেখে আসি।

কত স্মৃতি কতো ঘটনা দৃশ্যপটে ভাসে।

সাচনা বাজারের খুবই আধুনিক স্টাইলিশদের একজন।

এখনকার জমানার নয়,সেই ত্রিশ চল্লিশ বছর আগের জমানায় দেখতাম সিলসিলা শার্ট, বকলেস টিশার্ট, ফিটিং সেলাই করা প্যান্ট, গলায় সোনার চেইন।

যাত্রাপালা, নাটক বা যে কোনও অনুষ্ঠান উনাকে ছাড়া কল্পনাই করা যেতো না।

তখন থেকেই উনার ফ্যাশন আমায় খুব টানতো। আমাদের ছোট বেলায় জামালগঞ্জ থানা এলাকায় ফ্যাশনবল যুবক খুব কমই চোখে পড়তো। হাতেগোনা কয়েকটি পরিবারের মধ্যেই ফ্যাশন নিয়ে ভাবনাচিন্তা হতো। মাঝে মাঝে প্রতিযোগিতাও হতো।
এই প্রতিযোগিতার একজন ছিলেন পংকজ দা।

একটা ঘটনা আজ না লিখে পারছি না। ৯২ সালের বাবরি মসজিদ নিয়ে ভারতের পরে বাংলাদেশেও দাঙ্গা বাঁধে অনেক এলাকায়।

আমি তখন জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক হলেও একদম বেকার। সাচনা বাজার স্কুলে সময় কাটাই। অনারারি টিচার হয়ে সাচনা মাঝে মাঝে ক্লাশ নেই।

শম্ভু দা, ইয়াহিয়া ভাই, অনন্ত দার সাথে দিনরাতের প্রহর কাটাতাম।

এই সময় দাঙ্গা লাগে। সুনামগঞ্জেও বিশাল মিছিল নিয়ে শহরের কয়েকটি মন্দির ও আখড়ায় হামলা হয়েছে।

সাচনা বাজার এমনিতেই হিন্দু অধ্যুষিত। শত শত বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যের জনপদ। এই বাজারে ঢুকলেই হাজার বছর ধরে বহমান বাংলার রুপ দেখা যায়। বাজারের কালীগাছতলা আর বটতলায় গেলেই মনে হতো ইতিহাসের পাতায় ঢুকে গেছি। বিভিন্ন মোকামের সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আর শুধু পিছনের ইতিহাস খোঁজতাম। ভৈরবের লঞ্চ আর কার্গোর হুইসেলে সাচনা বাজারে রাত হতো দিনের মতো কর্মচঞ্চল।
শত শত শ্রমিকের হাঁকডাক ভাটি এলাকার এই বাজারকে দিয়েছিলো ঐতিহ্যের স্মারক।

সেই সাচনাবাজার তখন ভয়ার্ত। নিস্থব্ধ। আতংকিত। অজানা আশংকায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে বণিক পরিবারগুলিতে। আমার বন্ধু বান্ধবীরা আমাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখতে। রেখার চোখে সন্দেহের রেখা বড় হয়। লঞ্চঘাটের বৃদ্ধ রামছাগল দুইটাও নির্জীবের শুধু তাকিয়ে মানুষ মাপে। কালীগাছে পেঁচার আনাগোনা বেড়ে যায়।

আড্ডায় থাকা শম্ভুদা, অনন্ত দা হঠাৎ নির্লিপ্ত হয়। কবিতা দুঃখের গল্প হয়ে গেছে।

তাদের মূখে কোনও কথা নেই। অনেক রাতে জানালেন আগামীকাল থেকে তাদের সাথে আমাদের আর দেখা হবেন। কারন পরশুদিন সাচনা বাজারে আগুন দেয়া হবে আখড়া মন্দির আর সবগুলো মোকামে।
সব আয়োজন হয়ে গেছে। প্ল্যান প্রোগ্রাম শেষ। দুইদিক থেকে একই সাথে দুইটা মিছিল আসবে বাজারে। আর জামালগঞ্জ থেকে নদী পার হয়ে আসবে আরেকটি মিছিল।

স্থানীয় নেতারা অনেকে কিচ্ছুই জানেন না।
যে কারনে অনন্ত দা আর শম্ভু দা আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। বেঁচে থাকলেও আর হয়তো দেখা হবে না।

আমি বললাম। চলুন শেষ বারের মতো একসাথে একটু হাঁটি। আপনারা ছাড়া এই বাজারে আমারও আসা হবে না।

বাজারে ভুতের পায়ের মতো হাঁটছি। হঠাৎ বললাম আপনারা আমাকে এখন সুনামগঞ্জ পাঠাতে পারবেন?
তারা জানতে চান। কেন?
বল্লাম আগে পাঠান। পরে বলবো। আমার কাছে টাকা নেই। বেকারের পকেট। উনাদের কাছেও নাই। বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে গেলাম। কিন্তু কেউ টাকা দিলো না। টাকা পেলেও কিভাবে যাবো? তখন তো ট্রলার ছাড়া রাস্তা নাই।

তিনজনে মিলে পংকজ দার বাসায় যাই। আমার প্ল্যান শুনে তিনি আমাকে ৫০০ টাকা দেন। এবং নিজেই ট্রলার ঘাটে এসে ৩০০ টাকা দিয়ে একটি ট্রলার রিজার্ভ করে দিলেন।
আজানের সময় একা ট্রলার ছাড়ি।
সুনামগঞ্জ এসে সব জানাই বরুন কাকা ও জহুর সাহেবকে। জহুর সাহেব আরো কয়েকজনকে ফোন করলেন। তিনি তখন বিরোধীদলীয় এমপি।

ডিসিকে বললেন, আর যদি একটা মন্দিরে হামলা হয় আমি আত্মহত্যা করবো। মোক্তার সাহেব এক ডিগ্রী বাড়ীয়ে। এস পিকে বললেন, আমি পেট্রোল নিয়ে আসিতেছি। আপনার অফিসে আমি নিজের গায়ে আগুন দিয়া জালাইলিমু। তবুও ডিসি এসপি জামালগঞ্জ আসতে রাজি হচ্ছেন না।

সামাদ সাহেব, সেন বাবুর সাথেও যোগাযোগ করলাম। তাঁরা ডিসি এসপিকে চাপ দিলেন। এক ঘন্টার মধ্যে ডিসি জহুর সাবকে ফোন দিলেন এবং আমন্ত্রণ জানালেন জামালগঞ্জ যাওয়ার জন্যে।
আমরা বালুর মাঠে এসে দেখি। সাজ সাজ রব রব অবস্থা। ৮/৯ টি স্পীড বোট। পুলিশ বিডি আর। বরুন কাকা, মোক্তার সাব, আতমসালেহ ভাই, হুমায়ুন ভাই, রব্বানী ভাই, জগলু ভাই আরো অনেক ছাত্রনেতাদের দাওয়াত দিলাম। তারাও এলেন।

আমি জহুর সাবের বোটে উঠি। দুপুর বেলায় জামালগঞ্জ আসি। এসে দেখি থমথমে অবস্থা। মিলনায়তনে তিল ধারনের ঠাঁই নাই।
সব মসজিদ মাদ্রাসা, স্কুলের প্রধানদের আগেই ডাকা হলো। স্থানীয় সকল রাজনৈতিক সামাজিক নেতারা তো ছিলেনই।

অনেক কথাবার্তা তর্কবিতর্ক হলো।
তিন দিনের জন্যে সাচনা বাজার সহ জামালগঞ্জের একমাইলের সীমানা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারী করা হলো।

আজ অনেক দিন পরে পংকজ দার সাথে সেই ৫০০ টাকার কথা মনে হলো। তিনি নাই। ৫০০ টাকার কাহিনী রয়ে গেলো।

দাদা। টাকা এই বাজারে অনেকের ছিলো। আরো অনেকের হবে। কিন্তু খরচ করার বা দান করার মতো মন কয়জনের হবে??

এই বাজার আর বাজারের মানুষেরা আপনাকে ভুলবে কি না জানি না।

আমি পারবো না।।

সংবাদ অনুসন্ধান ক্যালেন্ডার

MonTueWedThuFriSatSun
    123
18192021222324
252627282930 
       
  12345
2728     
       
28      
       
       
       
1234567
2930     
       

আমাদের ফেইসবুক পেইজ