আমাদের বর্ণবৈষম্য

প্রকাশিত: ১২:২১ পূর্বাহ্ণ, জুন ১২, ২০২০

আমাদের বর্ণবৈষম্য

তসলিমা নাসরিন :; ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়ায় অর্থাৎ সাদাদের দেশগুলোয় যখনই কোনও বর্ণবৈষম্যের খবর পাই, তখন ভীষণ ক্ষিপ্ত হই আমরা, বিশেষ করে আমাদের লোকেরা যদি আক্রান্ত হয়। কালোরা আক্রান্ত হলে আমাদের খুব একটা অবশ্য যায় আসে না। কালোদের কি আমরা ঘৃণা করি না? আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ, আমরা দু’শ বছর ঔপনিবেশিক শক্তির অপশাসন আর শোষণের শিকার হয়েছি। সাদা ব্রিটিশ শাসকরা কালো আফ্রিকানদের যেমন ঘৃণা করতো, ভারতীয়দেরও তেমনই ঘৃণা করতো। কিন্তু ভারতীয়রা চিরকালই কালো আফ্রিকানদের চেয়ে নিজেদের উন্নত জাতের মানুষ বলে ভেবে এসেছে। আফ্রিকার কোনও কোনও জাত মানুষখেকো, ব্রিটিশরা বলেছিল। শিক্ষাটা এত গভীরে ঢুকেছে যে আজ ঔপনিবেশিক শাসন নেই ৭০ বছরের চেয়েও বেশি, তারপরও আফ্রিকার যে কোনও লোককে দেখলেই মানুষখেকো বলে আমাদের অনেকেরই সংশয় হয়। আফ্রিকা থেকে ভারতে অনেকেই লেখাপড়া করতে আসে। তাদের যে কী হেনস্তা হতে হয় গায়ের রঙ কালো বলে! সুদান, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, ইরেত্রিয়া যেখান থেকেই আসুক, সব ছাত্রছাত্রীকে ভারতীয়রা ‘নাইজেরিয়ান’ বলেই ডাকে। এবং সব নাইজেরিয়ানকেই তারা মনে করে মাদক ব্যবসায়ী, এবং পতিতার দালাল। মনে আছে দিল্লির ফরেনার রেজিস্ট্রেশন অফিসে একবার ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য গিয়েছিলাম। একজন আফ্রিকার লোকও ভারতীয় এক মহিলার সংগে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হওয়ায় ভারতে বাস করার ভিসার জন্য ওখানে গিয়েছিলেন। যে অফিসার আমাকে বসিয়ে চা খাওয়াচ্ছিলেন, তিনিই আফ্রিকার লোকটির সংগে জঘন্য ব্যবহার করলেন, জঘন্য গালি দিলেন। আমাকে বললেন আফ্রিকার লোকেরা খুব খারাপ, এরা মানুষখেকো, এবং মাদক ব্যবসায়ী। রেগে ফেটে পড়লেন সেইসব ভারতীয় মহিলার বিরুদ্ধে, যারা আফ্রিকার লোকদের বিয়ে করে। একই অফিসার চমৎকার ব্যবহার করেছিলেন ভিসার জন্য আসা সাদা ইউরোপীয় লোকদের সংগে। আমেরিকায় কালোদের একসময় নিগ্রো বলে ডাকা হতো, নিগ্রো শব্দটি এখন গালি হিসেবে প্রচলিত। ভারতেও নিগ্রোর মতো নাইজেরিয়ান শব্দটি একটি গালি। এত উপেক্ষা, এত অপমান জোটে, আফ্রিকানরা তারপরও ভারতকে ভালোবেসেই ভারতে আসে।

আফ্রিকার লোকদের ওপর ভারতীয়রা প্রায়ই হামলা চালায়। ২০১৭ সালে ৫ জন নাইজেরিয়ার ছাত্রকে ভারতীয়রা লোহার রড, ছুরি ইত্যাদি দিয়ে হামলা করেছিল। একটি অল্প বয়সী ছেলের মাদক সেবন করে মৃত্যু হয়েছিল, ছেলেটির বাবা জানিয়েছিল যে ছেলেটি মাদক পেয়েছিল এক নাইজেরিয়ানের কাছ থেকে। এর প্রতিশোধ নেওয়া হয় নাইজেরিয়ার ছাত্রদের অমানুষের মতো পিটিয়ে। মানুষ দেখেছে এই পেটানো, কেউ ওদের থামায়নি, পুলিশকেও খবর দেয়নি। দেবে কেন, কালো লোকদের তো তারাও ঘৃণা করে। ভারতে আফ্রিকার নাগরিকের ওপর হামলা নতুন কিছু নয়। দিল্লিতে ২০১৬ সালে কঙ্গোর এক লোককে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল ভারতীয়রা। এর আগে তানজানিয়ার এক ছাত্রীকে ব্যাঙ্গালোরে টেনে কাপড় খুলে দিয়েছিল। ২০১৩ সালে গোয়ায় এক নাইজেরিয়ান লোককে ছুরি দিয়ে আঘাতে করে মেরে ফেলা হয়েছিল। আফ্রিকার ছাত্রদের রাস্তা-ঘাটে গালি শুনতে হয়, বাড়িওয়ালা তাদের ঘর ভাড়া দিতে চান না, প্রচুর ডকুমেন্টস দেখাতে হয় ভাড়া পেতে গেলে। বিদেশ থেকে যে সাদা লোকেরা আসে পড়তে, গবেষণা করতে, চাকরি বা ব্যবসা করতে, তাদের কিন্তু এই অসুবিধে হয় না।
শুধু যে আফ্রিকার লোকদের গায়ের রঙকে আমরা অপছন্দ করি তা নয়। নিজেদের মধ্যে যাদের গায়ের রঙ কালো, তাদেরও তো আমরা গ্রহণ করি না। তারা সুন্দরী হলেও তাদের আমরা সুন্দরী বলে ডাকি না। গায়ের রঙ ফর্সা করার ক্ষতিকর কেমিক্যালে ছেয়ে গেছে আমাদের গোটা অঞ্চল। উপজাতিদের মধ্যে যারা কালো, দলিতদের মধ্যে যারা কালো তাদের মানুষ বলেই মেনে নিই না। নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশের মানুষ কালো নয়, কিন্তু ওরা দেখতে অধিকাংশ ভারতীয়দের মতো নয়, আমাদের মতো দেখতে নয়। তাই ওদেরও কিন্তু একই হাল করা হয়, যথেষ্ট ঘৃণা উথলে উঠলে ওদেরও পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। আমরাই মেরে ফেলি।

চলচ্চিত্র নির্মাতা মাইকেল মুর একবার নিউইয়র্কের রাস্তায় দুজন লোককে ট্যাক্সি ডাকার জন্য দাঁড় করিয়েছিলেন, একজন কালো, তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আরেকজন সাদা, তিনি একজন বড়সড়ো ক্রিমিনাল। ট্যাক্সি সাদার কাছে থেমেছে। কালোর কাছে একটি ট্যাক্সিও থামেনি। নিউইয়র্কে বাংলাদেশের বাঙালিরা ট্যাক্সি চালায়, আফ্রিকান আমেরিকানদের আগে ‘কাইল্যা’ বলে গালি দিয়ে তারপর ওদের সম্পর্কে কথা বলে। আমাদের রঙ যতই কালো হোক, নিজেদের আমরা কালোদের থেকে পৃথক বলে ভাবি। অনেক সময় আমরা তো নিজেদের সাদা বলে ভাবতে থাকি, বিশেষ করে যখন কালোদের কীর্তিকলাপের দিকে তাকাই।

দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়রা কিন্তু কালোদের মতো জাতিগত বৈষম্যের শিকার হয়েছে। তারপরও ভারতীয়রা সবাই মিলেমিশে থাকে না। ওদের মধ্যে জাতপ্রথা বা কাস্ট সিস্টেম নেই। ভারত থেকে সমুদ্রপথে আসার সময় জলে ডুবিয়ে দিয়েছিল ওই প্রথা। তা ঠিক, কিন্তু যারা চুক্তিভুক্ত শ্রমিক ছিল, আর যারা গিয়েছিল বাণিজ্য করতে, এ দুই ধরনের ভারতীয়দের মধ্যে ফারাক ছিল। এই শ্রেণির ফারাকের বাইরে আরও একটি ফারাক ছিল এবং এখনও আছে সেটি হলো, ভারতীয়দের মধ্যে কারও গায়ের রঙ কালো, কারও গায়ের রঙ বাদামি। কালো ভারতীয়দের খানিকটা নিম্নমানের মানুষ হিসেবেই মনে করে বাদামি ভারতীয়রা। দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়রা সদ্য বিলেত-ফেরত ব্যারিস্টার মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে উকিল হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওখানে গান্ধী নিজেও তো দেখতে অনেকটাই কালো, কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার কালো লোকদের নিম্নমানের মানুষ বলে মনে করতেন। ওদের গালি দিতেন ‘কাফির’ বলে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘কাফির’ খুব অপমানজনক গালি। বছর দুই আগে ঘানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে ছাত্রছাত্রীরা এ কারণেই গান্ধীর মূর্তি সরিয়ে ফেলেছে। এত বড় মহাত্মাই যদি বর্ণবাদী, আমরা কোন ছার!

বর্ণবাদী নয়, এমন লোক ভারতীয় উপমহাদেশে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এখানে মানুষ নিজের ধর্ম, বর্ণ, জাতের চেয়ে অন্যের ধর্ম বর্ণ জাতকে নিম্নমানের বলে মনে করে। ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাই ধর্মবাদী, বর্ণবাদী, গোষ্ঠীবাদী, জাতবাদী, জাতীয়তাবাদী, শ্রেণিবাদী। যারা এসবের ঊর্ধ্বে উঠেছে, তাদের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য।

আমেরিকায় বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে এই করোনাভাইরাসের মহামারীর সময় যে প্রতিবাদ হলো তার তুলনা হয় না। এ নিয়ে যতবারই আমি টুইটারে লিখেছি, ততবারই অজস্র মানুষের কটাক্ষ শুনেছি। তারা ভারতীয় উপমহাদেশেরই লোক। তারা লুটপাট করার জন্য কালোদের দোষ দিচ্ছে, সে দিক। দোকানপাট যারা লুট করেছে, তারা অন্যায় করেছে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু হাঁটু দিয়ে চেপে জর্জ ফ্লয়েড নামের কালো লোককে মেরে ফেলা? ওটিকে টুইটারের ভারতীয়রা বলছে জর্জ ক্রিমিনাল ছিল, মেরেছে বেশ করেছে অথবা বলছে নিজের অসুখ-বিসুখের কারণে জর্জ মারা গেছে, শ্বাসরোধ হয়ে মরেনি।

এই হচ্ছি আমরা। আমরা কালোদের যত ঘৃণা করি, তত ঘৃণা সাদারাও করে না। নিজেদের গায়ের রঙ কালো হলে আমরা নিজেদেরই ঘৃণা করি। আমার এক অন্ধ্রপ্রদেশের বন্ধুর ত্বক খুব কালো। দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ মানুষের গায়ের রঙ কালো। কিন্তু সেই বন্ধুটি কিছুতেই তার গায়ের কালো রঙকে মেনে নিতে পারে না। নিজেই নিজের রঙকে কুৎসিত ভাষায় গালি দেয়। বারবারই বলে সে আসলে বাদামি, কিন্তু কদিন রোদে ঘোরা হয়েছে বলে কালো দেখাচ্ছে। নিজে সবসময় এক স্পেশাল সাবান রাখে সংগে, ওটা দিয়ে মুখটা পনেরো কুড়ি মিনিট ধরে ঘষে একটু যেন উজ্জ্বল দেখায়। এই তো আমরা। আমরা এমনই। আমাদের বর্ণবৈষম্য পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ংকর বর্ণবৈষম্য। মেয়ে কালো হলে তাকে আমরা জন্মের পরই মাটিতে জ্যান্ত পুঁতে ফেলি। অথবা তাদের সংগে আমরা প্রেম করি না, তাদের আমরা বিয়ে করি না, বিয়ে যদি করিই টাকার জন্য করি, বিরাট অংকের যৌতুক নিই, অথবা ঘরের নোংরা সাফ করার জন্য রেখে দিই।

আমাদের বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ করি না। কারণ আমরা ততটা সভ্য এখনও হইনি, যতটা সভ্য হলে বৈষম্যহীন সমাজের জন্য আপসহীন সংগ্রাম করা যায়।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সুত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন

সংবাদ অনুসন্ধান ক্যালেন্ডার

MonTueWedThuFriSatSun
    123
252627282930 
       
  12345
2728     
       
28      
       
       
       
1234567
2930     
       

আমাদের ফেইসবুক পেইজ