সিলেটের আকাশ থেকে এক নক্ষত্রের পতন !

প্রকাশিত: ২:০৭ অপরাহ্ণ, জুলাই ৩, ২০২০

সিলেটের আকাশ থেকে এক নক্ষত্রের পতন !

সিলনিউজ বিডি :: এম এ হক নাম হলেও হক সাব হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। আরও ফোকাস করে বললে বিএনপির হক সাব। সততা ও আদর্শভিত্তিক রাজনীতির এক প্রবাদ পুরুষ। আজকের রাজনীতিতে যে ধান্ধাবাজি তা থেকে শত হাত দূরে ছিলেন এম. এ হক। এজন্য বিএনপির অনেকেই তাঁকে সহজ সরল মানুষ হিসেবে ভাবতেন এবং এও বলতেন যে, তিনি রাজনীতির জন্য উপযুক্ত নন।

তাহলে কেন তাঁকে দীর্ঘদিন জেলা বিএনপির সভাপতি হিসেবে রাখা হলো- জানতে চাইলে বলতেন টাকার জন্য। যেকোনো কর্মসূচী বাস্তবায়নে এম. এ হকের অর্থায়ন ছিল জরুরি। এক সময় সাবেক অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান ও ইলিয়াস আলীর দাপটে বিএনপির রাজনীতি থেকে হারিয়ে যান রাজনীতিতে সততার মূর্ত প্রতীক এম. এ হক। তিনিও অভিমানে নিজেকে ঘুটিয়ে নেন। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় বিএনপির দুঃসময়ে যখন বেগম খালেদা জিয়া তাঁর প্রিয় এম. এ হক কে ফোন করে সক্রিয় হওয়ার জন্য বলেন, তখন তিনি আর বসে থাকতে পারেননি। কথা বলেন বিএনপি ও বেগম জিয়ার পক্ষে সব অভিমান ভুলে।

হক সাহেবের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিছক গ্রাহক-ব্যাংকার হিসেবে। ইসলামী ব্যাংক লালদিঘীরপাড় শাখার বিনিয়োগ গ্রাহক ছিলেন এম. এ হক। ম্যানেজার মো. আব্দুল লতিফ স্যার, সেকেন্ড অফিসার এম. এ মালিক স্যার ও বিনিয়োগ অফিসার ইকবাল ভাই অনেক কষ্ট করে এম. এ হক সাহেবকে রাজি করান বেঙ্গল গ্যাসোলিনের জন্য বিনিয়োগ গ্রহনে। তিনি রাজি হন। সিলেটে এটাই ছিল প্রথম গ্যাস পাম্প যা ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগে শুরু হয়েছিল। ইকবাল ভাই হেড অফিসে বদলি হয়ে যাওয়ার কারনে হক সাহেবের সঙ্গে সরাসরি আমাকেই প্রকল্পটি ডিল করতে হয়।

বিনিয়োগ প্রস্তাব হেড অফিসে পাঠানোর পর তারা একটির পর একটি ডকুমেন্ট চাচ্ছে। এতে অনেক দেরি হচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে একবার হক সাব ব্যাংকে আসেন। আমরা এই কাগজ সেই কাগজ চাচ্ছি তাঁর কাছে। এক সময় হেড অফিস থেকে ইকবাল ভাই আমাকে পরামর্শ দিলেন হক সাবকে রাজি করায়ে হেড অফিসে বসের কাছে একটি ফোন দিয়ে তদবির করানোর জন্য। সম্ভবত তখন ২০০৪/০৫ সাল। বিএনপি ক্ষমতায়। সিলেটের হক সাহেবের একটি ফোনের অনেক ক্ষমতা। আমিও খুশী হয়ে ভাবলাম ভালোই হবে। হক সাবকে বলে একটি ফোন করায়ে নেব। তাড়াতাড়ি লোন অনুমোদন হয়ে যাবে। আমার ঝামেলাও শেষ হয়ে যাবে, হক সাহেবও খুশী হবেন।

কিন্তু আমি যখন হক সাহেবকে ব্যাংকের হেড অফিসে সরাসরি একটি ফোন করে তদবিরের কথা বললাম তখন তাঁর জবাব শুনে অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি। ভাবতে থাকি এই যুগেও এমন মানুষ আছে! এরপর থেকে তিনি আমার মনোজগতে সম্মানের ভিন্ন এক উচ্চতায় সমাসীন ছিলেন। আজও আছেন।

তদবীরের কথা শুনেই তিনি আমাকে বললেন, মাহমুদ সাব আমি কাউকে ফোন করবো না। আমার অফিসার আপনি, শুধু আপনার কাছেই তথ্য ও অগ্রগতি জানতে চাইবো। যদি হেড অফিসে আমার ফোন না করার কারনে লোন অনুমোদন না হয়, কোনো সমস্যা নেই। আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকবে। আমি একটুও কষ্ট পাবো না। তবে আমি কোনো তদবির করবো না। তদবির ছাড়া লোন অনুমোদন হলে আলহামদুলিল্লহ। না হলেও সমস্যা নেই। তদবির আমি পছন্দ করি না। আমার লোনের জন্য আমি ফোন দিয়ে তদবির করবো এটা আমার জন্য অসম্মানজনকও।

অবশ্য কোনো তদবির ছাড়াই কিছুদিনের মধ্যে আমরা সিলেটে বেঙ্গল গ্যাস পাম্পে প্রথম প্রকল্প বিনিয়োগ অনুমোদন করাতে সক্ষম হয়েছিলাম।

বিনিয়োগ গ্রহনের পর কখনও কোনো কিস্তি দিতে তাঁর দেরি হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। ২০০১ সালের বিএনপি সরকারের সময় যখন
বিএনপির অনেক পাতি নেতা ও ক্ষমতার অংশীদার জামায়াতের অনেক নেতার দাপটও দেখার মতো ছিল, তখনও এম. এ হক সাহেবের ব্যবহারে যে বিনয় ও নম্রতা দেখেছি তা আজও স্মুৃতিপটে জ্বল জ্বল করছে।

করোনার আলামত নিয়ে হক সাহেব নর্থইস্ট মেডিকেলে আছেন খবরটি শুনেই বুকের মধ্যে ধক করে উঠে। আজ মৃত্যু সংবাদটি শুনে স্মৃতির আয়নায় ভাসছে হক সাহেবের অনেক কথা। সুন্দর হাসি, চেহারায় নামাজের উজ্বল দাগ, বিনম্র ব্যবহার। একজন রাজনীতিক, একজন সমাজসেবী, একজন ব্যবসায়ী হিসেবে সিলেটের অভিভাবকতুল্য একজন সৎ মানুষের স্মৃতি।

হে আল্লাহ, তোমার প্রিয় বান্দা হক সাহেবকে ক্ষমা করে দাও। তাঁকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে গ্রহন করুন।

লেখক : মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র।