সরকার হারাচ্ছে বিপুল অংকের রাজস্ব কুলাউড়ায় রেলওয়ের কোয়ার্টার অবৈধভাবে ভাড়া ও বিদ্যুৎ সংযোগ ঃ লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্র

প্রকাশিত: ৬:৪০ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৮, ২০২০

সরকার হারাচ্ছে বিপুল অংকের রাজস্ব কুলাউড়ায় রেলওয়ের কোয়ার্টার অবৈধভাবে ভাড়া ও বিদ্যুৎ সংযোগ ঃ লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্র

মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া রেলওয়ে জংশনের উত্তর ও ক্ষিণ কলোনিতে প্রায় পরিত্যক্ত প্রায় ড়ে শতাধিক কোয়ার্টার অবৈধভাবে ভাড়া দেয়া হয়েছে। কোয়ার্টারগুলোতে রয়েছে অবৈধ বিদুৎ ও পানির সংযোগ। রান্নার কাজে এসব বাসায় ব্যবহার করা হয় বৈদ্যুতিক হিটার বা চুলা। এসব কোয়ার্টার থেকে ভাড়া, বিদ্যুৎ ও পানির বিলের নামে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রভাবশালী এক সিন্ডিকেট চক্র। এতে সরকার হারাচ্ছে বিপুল অংকের রাজস্ব। কুলাউড়া রেলওয়ে শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে লাইনম্যান রিয়াজুর রহমান খোকন, জহির মিয়া ও খলিলুর রহমানের সহযোগিতায় লাখ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। এ চক্রের সমন্বয় করছেন কুলাউড়া জংশন স্টেশনে কর্মরত রেলওয়ে ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (ওয়ার্কস) জুয়েল হোসেন। তিনি নেপথ্যের কারিগর হিসেবে অবৈধপন্থায় লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে। এসব অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত হলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি এ অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, শতাধিক বাসায় অবৈধ বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ এবং বৈদ্যুতিক হিটার ব্যবহারের ফলে অতিরিক্ত লোড পড়ে স্টেশন এলাকায় স্থাপিত বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের ওপর। অতিরিক্ত বিদ্যুতের চাপে ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর একবার বিকল হয়ছিল ট্রান্সফরমারটি। যার ফলে তিনদিন বিদ্যুৎহীন ছিল গোটা স্টেশন এলাকা। অবৈধভাবে খল করা রেলওয়ে কোয়ার্টারগুলোতে চলছে বি্যুৎ সংযোগের মহোৎসব। প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে জ্বলে বিদ্যুতের হিটার চুলা। কুলাউড়া রেলওয়ে জংশনের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত কিছু অসাধু কর্মকর্তারা বিদ্যুৎ ও কোয়ার্টার থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা পেয়ে থাকেন। যার ফলে প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
রেলওয়ের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, রেলের বিদ্যুৎ বিভাগের মিটার রাইডার ও কুলাউড়া রেলওয়ে শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে লাইনম্যান রিয়াজুর রহমান খোকন, খলিলুর রহমান ও জহির মিয়ার সহযোগিতায় প্রতি মাসে লাখ টাকারও বেশি বিদ্যুৎ বিল উত্তোলন করা হয়। এ টাকার একটি বড় অংশ আইডাব্লিউ জুয়েল হোসাইনসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার পকেটে যায়। তাছাড়া রেলের খালি কোয়ার্টারগুলোও ভাড়া দেয় এ চক্রের লোকজন। এসব অবৈধ বাসায় চলে রাত-বিরাতে মদ, জুয়া, পতিতাবৃত্তিসহ নানা অসামাজিক কার্যকলাপ। ফলে আয় হয় মোটা অঙ্কের টাকা। মাস শেষে আয়কৃত টাকা থেকে একটি ভাগ চলে যায় কুলাউড়া রেলওয়ে জংশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার কাছে। যার ফলে এসব বিষয় তারা জেনেও না জানার ভান করেন। আলাপকালে কুলাউড়া পরিত্যক্ত রেলওয়ে স্টেশনের উত্তর ও ক্ষিণ কলোনীর বাসি›া রনি মিয়া, জাহানারা বেগম, রহিমা বেগম, সীমা বেগম, বদরুল হোসেন জানান, আমরা প্রতিমাসে জহির মিয়া ও রিয়াজুর রহমান খোকনের কাছে মাসিক ৫০০ টাকা করে বিদ্যুৎ বিল দেই। আগে আব্দুর রহিম এই বিল উত্তোলন করতেন।
রেলওয়ের একাধিক সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (ওয়ার্কস) জুয়েল হোসেন কুলাউড়া জংশন স্টেশনে নিজের অপকর্ম পরিচালনার জন্য ক্ষমতাসীন লের সংগঠনের নেতাকর্মীরে যোগসাজশে গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের সহযোগিতায় নিজের অপকর্ম নির্বিঘ্নে চালিয়ে যান। সূত্র আরও জানায়, কুলাউড়া জংশন স্টেশন আবাসিক এরিয়ায় শতাধিক পরিত্যক্ত কোয়ার্টার প্রতিটির মাসিক কমপক্ষে ুই হাজার টাকা করে ভাড়া দিয়েছেন। ভাড়া বাব মাসে এসব বাসা থেকে ুই লক্ষাধিক টাকা উত্তোলন করা হয়। এ টাকা উত্তোলন কাজে নিয়োজিত রয়েছেন টিটু নামে রেস্টহাউসের এক অস্থায়ী স্টাফ। এছাড়া এসব পরিত্যক্ত কোয়ার্টারে বি্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হয়। পরিত্যক্ত কোয়ার্টারসহ প্রায় একশ’টি কোয়ার্টারে বৈদ্যুতিক হিটার জ্বালানো হয়। শতাধিক বাসা থেকে প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকা অবৈধ বিল উত্তোলন করা হয়। এই বিভাগের ইলেকট্রিক লাইনম্যান রিয়াজুল এ টাকা উত্তোলন করেন। অথচ প্রতি মাসে সরকারি কোষাগার থেকে কুলাউড়া স্টেশনে বিদ্যুৎ খাতে হাজার হাজার টাকা বিল ভর্তুকি দেয়া হয়। করোনাভাইরাসে লকডাউনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হওয়ার আগে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন একটি প্রতিনিধি ল কুলাউড়া স্টেশন পরির্শনে এলে রেলওয়ের অবৈধ বৈদ্যুুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু সেই বিচ্ছিন্ন সংযোগ পুনরায় দিতে গ্রাহকদের কাছে ফের অর্থ াবি করেন ইলেকট্রিক লাইনম্যান রিয়াজুল। এতে পরিত্যক্ত কোয়ার্টারের বাসি›ারা ক্ষুব্ধ হয়ে রিয়াজুলের ওপর হামলা চালান। এতে তারা মাথা ফেটে যায়। বিষয়টি জেনেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। কুলাউড়া স্টেশনের পানির ট্যাঙ্কি থেকে রেলস্টেশনের বিভিন্ন দোকানে ও পরিত্যক্ত বাসায় টাকার বিনিময়ে দেয়া হয়েছে অবৈধ পানি সংযোগ লাইন। অথচ স্টেশনের বাথরুমে পানির লাইন সংযোগ না থাকায় যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, রেলওয়ের কলোনীতে অবৈধভাবে ভাড়া দেয়া প্রায় দেড় শতাধিক বাসায় অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। অবৈধ ভাবে সংযোগ নেয়া এসব বাসা বাড়িতে রয়েছে লাইট, ফ্যান, ফ্রিজ, ইলেকট্রিক আয়রন, রান্নার হিটার ও কোন কোন বাসায় পানি উত্তোলনের মটর ব্যবহার হতে দেখা যায়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কুলাউড়া রেলওয়ে জংশনে বিদ্যুৎ অফিসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের সঙ্গে জড়িত। ওইসব অবৈধ সংযোগ থেকে মাসে ৫’শত থেকে ৭’শ টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হয়। এভাবে প্রতিমাসে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অসাধু চক্রটি। আর অতিরিক্ত ব্যবহৃত বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করছে রেল কর্তৃপক্ষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের নিরাপত্তা বিভাগের এক কর্মচারী জানান, অবৈধ গ্রাহকরা বিদ্যুৎ ব্যবহারের পাশাপাশি তাদের বাড়িতে নিয়মিত বৈদ্যুতিক চুলা (হিটার) ব্যবহার করে। রেলওয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের লোকেরা এসব অবৈধ সংযোগের সঙ্গে জড়িত। রেলের বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু অসাধু কর্মচারী মাস শেষে ২টি কলোনি থেকে লাখ লাখ হাতিয়ে নিয়ে যায়। ওই ব্যক্তিগুলি স্থানীয় প্রভাবশালী বলে তাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না।
এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী কুলাউড়া (আইডাব্লিউ) মো. জুয়েল হোসাইন তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কুলাউড়া রেলওয়ে জংশন এলাকায় ২৫০টির মতো কোয়ার্টার আছে। এর মধ্যে প্রায় ১৫০টি বরাদ্দ দেয়া আছে। বাকি ১০০টি কে বা কারা ব্যবহার করছে আমি জানি না। তিনি জানান, আমি বাসা বাড়ি মেরামতের ায়িত্বে আছি। ভাড়া য়োর বিষয়টি আমার কাজ নয়। যদি অবৈধভাবে কেউ কোয়ার্টার ভাড়া দিয়ে থাকে তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিদ্যুতের বিষয় দেখা আমার ব্যাপার না, বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন আছে তারা দেখে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেটের একজন ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী বলেন, এসব বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। প্রভাবশালী সিন্ডিকেট রয়েছে, যাদের নেতৃত্বে অবৈধ বাসা খল করে বি্যুৎ সংযোগ দিচ্ছে। তবে এরা যতই প্রভাবশালী হোক কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। তদন্তক্রমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো: শামসুজ্জামান (০১৭১১-৫০৫৩৮৩) এর কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর পরে কথা বলবেন বলে লাইন কেটে দেন।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ