ধর্মীয় ঐতিহ্য ও অর্থনীতিতে কোরবানি

প্রকাশিত: ১:৩৮ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ২৯, ২০২০

ধর্মীয় ঐতিহ্য ও অর্থনীতিতে কোরবানি

যুবায়ের আহমাদ :;
আল্লাহর নৈকট্য লাভের অনন্য মাধ্যম কোরবানি। কোরবানির ঐতিহ্য মানবেতিহাসের সূচনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। হজরত আদম (আ.)-এর ছেলে হাবিল ও কাবিল পৃথিবীর ইতিহাসে কোরবানির সূচনা করেন। তাদের দুজনের মধ্যকার একটি অমীমাংসিত বিষয়ের সুষ্ঠু ঐশী ফয়সালা লাভের প্রত্যাশায় হজরত আদম (আ.) উভয়কে কোরবানি করার নির্দেশ দেন। সেকালে আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে কোরবানিকে ভস্মীভূত করা ছিল কোরবানি কবুল হওয়ার নিদর্শন। হাবিল ভেড়া, দুম্বা আর কাবিল কিছু শস্য, গম কোরবানির জন্য পেশ করলেন। হাবিলের কোরবানি কবুল হয়েছিল। আল কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তাদের আদমের দুই ছেলের কাহিনি শুনিয়ে দিন, যখন তারা উভয়ে কোরবানি করল, একজনের কোরবানি কবুল হলো, অন্যজনের কোরবানি কবুল হলো না।’ সুরা মায়েদা, আয়াত ২৭। একেক সময়ে কোরবানির রীতিনীতিতে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও আদিপিতার সময় থেকে শুরু করে সব নবী-রসুলের যুগে কোরবানির প্রচলন ছিল।

তারই ধারাবাহিকতায় হজরত ইবরাহিম (আ.) তাঁর প্রিয় বস্তুকে কোরবানির নির্দেশপ্রাপ্ত হন। আল্লাহর খলিল ইবরাহিম (আ.) কোনো প্রকার অজুহাত বা যুক্তির আশ্রয় না নিয়ে আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন। পিতা তাঁর সন্তানকে কোরবানি করতে আর সন্তান নিজে আল্লাহর জন্য কোরবানি হতে প্রস্তুত হয়ে যান। আল্লাহ সেই সমর্পিত হওয়াকেই কবুল করে নেন। পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন হজরত ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর ছেলে। আল্লাহ ফেরেশতার মাধ্যমে প্রাণী পাঠিয়ে ইবরাহিমতনয় ইসমাইলের স্থলে তা কোরবানি করান। আর হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত হিসেবেই আজও কোরবানি চলমান। যেমনটি আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন। হজরত জায়েদ ইবনে আকরাম (রা.) বর্ণিত, ‘সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসুল! এ কোরবানি কী। তিনি বললেন, এটা তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত। সাহাবায়ে কিরাম আবার জিজ্ঞাসা করলেন, এতে আমাদের কী কল্যাণ নিহিত আছে। উত্তরে বললেন, এর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি রয়েছে। তাঁরা আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, বকরির পশমও কি তাই? জবাবে তিনি বললেন, বকরির প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে নেকি আছে।’ ইবনে মাজাহ।
কোরবানিদাতারা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টিই কামনা করেন। কোরবানির উদ্দেশ্যটা বাণিজ্যিক না হলেও কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির গতিশীলতায় এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাবে, এবার কোরবানির জন্য ১ কোটি ১০ লাখ প্রাণীর প্রয়োজন হবে। ৪৫ লাখ ৩৮ হাজার গরু/মহিষ ও ৬৫ লাখ ছাগল/ভেড়া কোরবানি হলে এতে হাতবদল হবে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। যেহেতু কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হয় তাই কোরবানির পশু কেনার সঙ্গে সম্পদশালীরা সম্পৃক্ত আর প্রাণী লালনপালনের সঙ্গে গরিবরা সম্পৃক্ত। তাই বলা যায়, এ ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রায় সবটাই ধনীদের হাত থেকে গরিবের হাতে যাবে। আর সম্পদের এ বিশাল হাতবদল অর্থনীতিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। গরু পালনকারী গরিব বা মধ্যবিত্তরা যখন এ টাকা পেয়ে ঈদের কেনাকাটা করতে যায়, তখন বিভিন্ন পণ্যের মার্কেট চাঙ্গা হয়ে ওঠে। লাভবান হয় অর্থনীতির প্রায় সব সেক্টর। কোরবানির গরু পালন করেই লাখো মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা হয়। কোরবানির প্রাণীর জোগান দিতে বিভিন্ন জেলায় গড়ে ওঠা খামারে কর্মসংস্থান হচ্ছে লক্ষাধিক মানুষের। হাট ইজারা ও পাশের দেশগুলো থেকে গুরু আমদানি করা হলে এ খাত দুটো থেকে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আসে। কোরবানির প্রাণীটি জবাই করার পর তার একটুও ফেলে দেওয়া হয় না; বরং পুরোটাই ভাগাভাগি করে আমরা খাই। কোরবানি উপলক্ষে কোটি দরিদ্র পরিবার তৃপ্ত হয়ে গোশত খাওয়ার সুযোগ লাভ করে। কোরবানির চামড়ার কয়েক হাজার কোটি টাকা সরাসরি চলে যায় গরিবের হাতে। এ টাকায় গরিবরা তাদের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণের সুযোগ পায়। চামড়া সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন হয় লবণের। চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা জড়িত।

লেখক : খতিব, বাইতুশ শফীক মসজিদ, গাজীপুর।
সুত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন